নিজস্ব প্রতিবেদক::: নারী নির্যাতনসহ সকল অন্যায় দমন-পীড়ন বন্ধের দাবি জানিয়ে খাগড়াছড়িতে ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, প্রতিবাদী নৃত্য ও সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন। বুধবার (৮ মার্চ ২০২৩) সকাল ৯টার সময় খাগড়াছড়ি সদরের চেঙ্গী স্কেয়ারে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের আগে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা মাঠ থেকে একটি মিছিল নিয়ে চেঙ্গী স্কোয়ারে অবস্থান নেয়।
এছাড়াও রাঙামাটি রোডের চেঙ্গী ব্রীজ থেকে একটি মিছিল এবং দীঘিনালা রোডের নারিকেল বাগান থেকে একটি মিছিল চেঙ্গী স্কোয়ার মোড়ে এসে সমাবেশে মিলিত হয়। এতে খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে সমাবেশে অংশ নেয় নারী ও শিক্ষার্থীরা। “নারীর নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ,আসুন, নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ হই, আন্দোলন গড়ে তুলি!” শ্লোগানে সমাবেশে এ যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার আদায় করতে গিয়ে যারা অপহরণ,খুন,গুমের শিকার হয়েছেন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেছেন তাদের প্রতীকী হিসেবে প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড প্রতিবাদী নৃত্য পরিবেশন করে।
এতে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা,সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমার সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য এন্টি চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান। এছাড়া সমাবেশে এসে সংহতি জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম ধানসিড়ি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষিকা মুন্নি ধর।
বক্তারা বলেন, পাহাড়ে নারী ধর্ষণ,খুন,গুম ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে নারীধর্ষণের ঘটনা ও সাম্প্রতিক সময়ে পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, বান্দরবান,রাঙামাটিতে পাহাড়ি নারী ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টা এবং রাঙ্গুনিয়ায় এক পাহাড়ি নারী এনজিও কর্মীকে খুনের ঘটনা কোন বিচ্ছন্ন ঘটনা নয়। ১৯৯৬ সালে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত না হওয়ার বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে পাহাড়ে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এক দিকে নারী ধর্ষণ অন্য দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখলসহ বান্দরবানে লামা সরইয়ে ৪০০ একরের অধিক রাবার বাগানের নামে ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিসত্তার জনগণকে নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা নারীরা পর্যন্ত বাড়ি থেকে সর্বত্র অনিরাপদ হয়ে পড়েছে।
নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের জন্য পুরুষদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে চালিয়ে যাতে হবে। তিনি একমাত্র পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পাহাড়ে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে বলে মন্তব্য করেন।
এতে বক্তারা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীদের ওপর যৌন আক্রমণ আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের মধ্যে ধর্ষণ অকল্পনীয়, পাহাড়িদের ভাষায় ধর্ষণের প্রতিশব্দও নেই। শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে নারীদের ওপর যৌন আক্রমণে প্ররোচনা দিচ্ছে, ধর্ষকদের রক্ষা করে চলেছে। ধর্ষণের মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রদানে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তারই প্রমাণ। এই নিপীড়ক সরকার পাকিস্তানীদের কায়দায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পাহাড়ি জনগণের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চালাচ্ছে। তার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন নারীরা।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা কোনো সামাজিক বা নৈতিক সমস্যা নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা। এখানে সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তরণ ও দমনমূলক অগণতান্ত্রিক ‘১১ নির্দেশনা’ জারি রেখে অন্যায় দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। তিনি এদেশের প্রশাসন ও রাষ্ট্রের পলিসিতে পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মা ভর করেছে বলে মন্তব্য করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ি জাতিসমূহকে শংকর বানিয়ে তাদের জাতিগত পরিচয় লুপ্ত করে দিতে চায়।
সমাবেশে আরো বলেন, ২০১৮ নৈশভোটে জালিয়াতি করে এ সরকার নির্বাচিত হয়েছে। ফলে প্রশাসনিক লোকেরা ভোট জালিয়াত,ঘুষ, দুর্নীতি,বিদেশে টাকা পাচারসহ ইত্যাদি কুকর্মে জড়িত। এ সরকার দুর্বলদের, নারী ওশিশুদের, অনগ্র সরদের, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। উল্টো নিজের গদিকে টিকে রাখার জন্য এ দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের কাজে লাগাচ্ছে। নীতি চাকমা আরো বলেন, সরকার উন্নয়নের নামে পাতালরেল, মেট্রোরেল,পদ্মাসেতুর বাহাদুরি দেখিয়ে তার অপরাধ ঢাকতে পারবে না। এদেশ অপহরণকারী,দুর্বৃত্তদের, লুটেরাদের দেশ নয়। এদেশ আমাদের। এদেশকে আমরাই সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করব। আমরা রুখেই দাঁড়িয়েছি। আমরাই নিরাপত্তা, অধিকার নিশ্চিত করবই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিগত নিপীড়ন চলছে। প্রতিনিয়ত ধরপাকড়, ঘর তল্লাশি মিথ্যা মামলায় হয়রানি, ভূমি বেদখল, পরিবেশ ধ্বংসসহ নারী ধর্ষণ চালানো হচ্ছে। তিনি নারী ধর্ষণ ঘটনার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ২০২২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬ জন নারী শিশু যৌননিপীড়নসহ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ১ জন, ধর্ষণের শিকার ৫ জন,ধর্ষণ চেষ্টার শিকার ৬ জন। এছাড়াও চলতি বছরে বান্দরবানে লামায়, মাটিরাঙ্গায়, পানছড়িসহ ৬ জন নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও খুনের শিকার হয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণ শব্দটি ছিল না। সরকার গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নভাবে ঘৃণ্য কৌশলের কারণে এগুলো ঘটছে। ধর্ষক, খুনি, নিপীড়নকারীরা যদি ক্ষমতাবান হয় কিংবা ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় থাকে তাহলে তারা রেহাই পেয়ে যায়। রাষ্ট্রের এই বৈষম্যমূলক বিচারব্যবস্থা ও বিচারহীনতা নারীদের নিরাপত্তা আরো বেশি ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। তিনি রাষ্ট্রীয় এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে নারীদেরকে আরো বেশি সচেতন হওয়ার ও ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। সমাবেশ থেকে বক্তারা নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানান এবং নারী নির্যাতনসহ সকল ধরনের অন্যায় দমন-পীড়ন, জুলুম বন্ধ করে নিপীড়নমুক্ত সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি জানান। সমাবেশের পর চেঙ্গী স্কোয়ার থেকে আবারো মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি মহাজন পাড়া ঘুরে এসে স্বনির্ভরে গিয়ে শেষ হয়।