নিজস্ব প্রতিবেদক:: দেশের বৃহত্তম বনাঞ্চল রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। পার্বত্য ৩ জেলায় শ্রেণিভুক্ত এবং অশ্রেণিভুক্ত রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ৪,৪০০ বর্গমাইল। এর মধ্যে উত্তরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ভৌগলিক অংশে রয়েছে প্রায় ১৩৮ বর্গমাইল (৮৮ হাজার ১শ’ ৮১ একর) সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তবে এসব বনের খবর জানেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তারা। নানা সীমাবদ্ধতা, বনের সীমানা চিহ্নিত করে না দেয়া এবং নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন তারা। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবে দশ’ বছরের কাচালং মাইনি হেড ওয়াটার বনাঞ্চলসহ খাগড়াছড়ির সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো দিন দিন হয়ে পড়ছে বৃক্ষশূন্য।
বাঘাইছড়ি সদর বাজার সংলগ্ন ব্রিজের পশ্চিম পাশের কাঠের টিপু বা স্টকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের থেকে সেগুন গামারি সহ মুল্যবান কাঠ সংগ্রহ করে নির্দিস্ট স্থানে নিয়ে এসে তারা মন গড়া মত সিজার লিস্ট করে টিপি ও চার্জলিষ্ট মিলিয়ে ছাড়পত্র নিয়ে থাকে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে স্থানীয় সদর বাঘাইছড়ি বন বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরা অনিয়মের সাথে জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে।
খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে অভিনব কায়দায় অবৈধ ভাবে রাতে ও দিনে কাঠ পাচার হয়ে থাকে। এতে রেঞ্জ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে পরিক্ষণ ফাড়ি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসব কাঠ পাচার করে থাকে। এছাড়াও যেসব কাঠ বোঝাই ট্রাক সমতলে যাচ্ছে তাতেই টিপি ও ছাড়পত্রের সাথে কাঠের সাইজের কোনো মিল থাকে না। বিভিন্ন মহলকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে এসকল অবৈধ কাঠ পাচার করে থাকে। এসব কাঠ ব্যবসায়ীদের সাথে খাগড়াছড়ি জেলা কাঠ ব্যবসায়ী সমীতির কর্মকর্তারা জড়িত বলে জানা গেছে। এসকল কর্মকর্তারা পাচার কাজে সহযোগিতা করে যাতে করে নির্ধিদায় সমতল জেলা কাঠ বোঝাই ট্রাক পাচারে বাধা গ্রস্থ্য না হয়। কাঠ বোঝাই ট্রাক গুলো যদি পরিক্ষা নিরিক্ষা করা হয় তাহলে আসল রহস্য বেড়িয়ে আসবে বলে ধারনা করেন সচেতন মহল।
জানা গেছে, প্রায় ৮৮ হাজার একর বনাঞ্চলের কাঠ রক্ষায় বন বিভাগের চেক স্টেশন রয়েছে কেবল ৩টি। দীঘিনালা উপজেলা থেকে খাগড়াছড়ি আসার আগে চেক করার জন্যে জামতলী বন ও শুল্ক পরীক্ষণ ফাঁড়ি রয়েছে। এরপর খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম রুটে মানিকছড়ি গাড়িটানা বিট কাম চেক স্টেশন এবং খাগড়াছড়ি-বারৈয়ারহাট রুটে রামগড় বিট কাম চেক স্টেশনে চেক করার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে বন বিভাগের এসব চেক স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট মাসোয়ারা দিয়ে নির্বিঘ্নে পাচার হচ্ছে চোরাই কাঠ। শুধু পাচার নয়, খাগড়াছড়ি জেলা সদরসহ ৮ উপজেলায় গড়ে ওঠা অন্তত ৩৬টি ইটের ভাটা ও করাতকলে মহাসমারোহে ধ্বংস হচ্ছে বন। বন আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপনের কোনো সুযোগ বা নিয়ম নেই। তবে এসবের তোয়াক্কা না করে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘিরেই অবৈধভাবে করাতকল স্থাপন করে দিনেরাতে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের কাঠ। কোনো কোনো করাতকলে মজুত করা কাঠের পরিমাণ ৮-১০ হাজার ঘনফুটেরও বেশি। যেখানে রয়েছে সেগুন, গামারি, গর্জন, জারুল, মেহগনি, তেলসুর, আকাশমণি, কাঁঠাল, চাঁপাফুল, গোদা এবং জামসহ বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ।
করাতকল মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি করাতকলে দৈনিক অন্তত ১০০-১৫০ ঘনফুট পর্যন্ত কাঠ চিরানো হয়। সে হিসেবে খাগড়াছড়ি জেলার করাতকল-গুলোতে প্রাত্যহিক গড়ে অন্তত সাড়ে ২২ হাজার ঘনফুট কাঠ চিরানো হয়।
মূলত প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় যুগ যুগ ধরে এভাবে অবাধে বন ধ্বংসের এ তাণ্ডব চলছে, তবে রহস্যজনক কারণে নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রাচীন পেশা জুম চাষও থেমে নেই। এর ফলেও ধ্বংস হচ্ছে সবুজাভ বনভূমি।
জানা গেছে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ভৌগলিক অংশে ৪টি বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতায় ৫৪ হাজার ১১২ একর, ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের আওতায় ১৮ হাজার ২৪৯.৬২ একর, অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চল বনীকরণ বিভাগের আওতায় ৯ হাজার ৬১৯ দশমিক ৫০ একর এবং খাগড়াছড়ি বন বিভাগের আওতায় রয়েছে ৬ হাজার ২০০ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এই ৪ বন বিভাগ মিলে খাগড়াছড়ি জেলার ভৌগলিক অংশে মোট সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পরিমাণ ৮৮ হাজার ১৮১ দশমিক ১২ একর।
খাগড়াছড়ি জেলার ভৌগলিক অংশে সবচে’ বড় সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে দীঘিনালা উপজেলার নাড়াইছড়িতে। নাড়াইছড়ি রেঞ্জটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের অধিভুক্ত। ৫৪ হাজার ১১২ একরের এই বনাঞ্চল পুরোটাই অরক্ষিত। এই বনাঞ্চলে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনিবন্ধিত পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আধিপত্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা ছাড়া এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যাতায়াত করতে পারেন না বন কর্মকর্তারা।
নাড়াইছড়ি রেঞ্জের ফরেস্টার আব্দুল জলিল বলেন, ‘এই রেঞ্জের সংরক্ষিত বনটি একেবারেই দুর্গম এবং ভারতের সীমান্তঘেঁষা। এছাড়া ওই এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ ও জেএসএস এর আধিপত্য রয়েছে। এসব সংগঠনের প্রভাবে আমরা অনেকটা অসহায় এখানে।’
লক্ষ্মীছড়ি রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চলটিও একেবারেই অরক্ষিত। তবে তা স্বীকার করেন না দায়িত্বরত কর্মকর্তা। ফরেস্টার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘১৬৫ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পুরোটাই বন বিভাগের দখলে আছে। নিয়মিত টহল দেয়া হয় সেখানে।’
খাগড়াছড়ি’র বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এই বন বিভাগের আওতায় যেসব সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে সবটুকুই আমাদের দখলে আছে। আমরা নিয়মিত ওই বনাঞ্চলে টহল পরিচালনা করছি এবং বনাঞ্চল রক্ষায় তৎপর আছি।’
সচেতন মহল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অবাধে বন ধ্বংসের ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু হয়েছে। বনের সীমানা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি, বনকে নিধনমুক্ত করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঠ কর্তনের ওপর একটি দীর্ঘ সময়ের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না গেলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে। আর এর প্রভাব কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই নয়, পুরো দেশের ওপর পড়বে।’