শিরোনাম
মঙ্গল. ডিসে ২৪, ২০২৪
উদ্বোধনের অপেক্ষায় খাগড়াছড়ির ৪২ সেতু

আল-মামুন, খাগড়াছড়ি: একটা সময় পাহাড়ী সড়কের ঝুকিঁপূর্ণ অস্থায়ী “বেইলী সেতু” ছিল একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন সড়কে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় হতাহত যেন নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। এতে মানুষের শংকা ও দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন। তবে সময়ের সাথে বদলেছে পাহাড়ের চিত্র।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খাগড়াছড়ির অধিকাংশ পাটাতনের বেইলী সেতু সরিয়ে নির্মান করা হয় স্থায়ী সেতু। সবশেষ জেলা উপজেলার আরো ৪২টি স্থায়ী সেতু নির্মান করা হচ্ছে। এতে পরিবর্তন আসবে খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগে।

ইতিমধ্যে সেতুগুলোর নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়। আগামী ২৯অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশের ১০০টি সেতুর সাথে খাগড়াছড়ির ৪২টি সেতু উদ্বোধন করবেন। ইতিমধ্যে এই সংক্রান্ত একটি চিঠি খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। বিভাগটির প্রধান প্রকৌশলী এ, কে, এম, মনির হোসেন পাঠান স্বাক্ষরিত চিঠিতে এই তথ্য জানানো হয়।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, “খাগড়াছড়ির জেলার বিভিন্ন সড়কে পিসি গার্ডার সেতু, আরসিসি সেতু ও আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প”র আওতায় প্রায় ২শ ৩৮কোটি ২৪লাখ টাকায় ৪২টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এরমধ্যে দীর্ঘ সেতুটি হচ্ছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি সড়কের লোগাং সেতু। ১৪৩ দশমিক ০৫মিটারের দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মানে ব্যয় হয়েছে ১১কোটি ৭১ লক্ষ টাকা। এরপরের দীর্ঘতম মানিকছড়ি-লক্ষীছড়ি সড়কে ১০০মিটার ধুরুং খাল সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ২৭লাখ টাকা। দিঘীনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি সড়কে ৭৯.০৫মিটারের পুজগাং বাজার সেতু নির্মানে ব্যয় হয়েছে ৭কোটি ৩২লাখ টাকা।

মাটিরাঙ্গা তানাক্কা পাড়া সড়কের ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের গোমতী সেতু নির্মানে ব্যয় ৬কোটি টাকা, মানিকছড়ি-লক্ষীছড়ি সড়কে ৪৪.০২মিটার জুর্গাছড়ি সেতু নির্মানে ব্যয় ৪কোটি ৬২ লাখ টাকা, হেঁয়াকো-রামগড়-জালিয়া পাড়া সড়কে সোনাইপুল সেতু নির্মানে ব্যয় ৫কোটি ২৮লাখ টাকা, দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং-পানছড়ি সড়কে ৪৪ মিটার দৈর্ঘ্যের পাবলাখালী সেতু নির্মানে ব্যয় ৪কোটি ৫৫লাখ টাকা।

একই সড়কে ৪৪মিটার দৈর্ঘ্যের বাঘাইছড়ি সেতু নির্মানে ব্যয় হয়েছে ৪কোটি ৫৫লাখ টাকা, ৪০ মিটার দৈর্ঘ্যের বাবুরোপাড়া সেতু নির্মানে ব্যয় ৪কোটি ৪৪লাখ টাকা, খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে ৩৭মিটার দৈর্ঘ্যের পেরাছড়া ব্রীজ নির্মানে ব্যয় ৪কোটি ৫৫লাখ টাকা, একই সড়কে ৩৭ মিটার দৈর্ঘ্যের গাছবান ব্রীজ নির্মানে ব্যয় ৪কোটি ৫৫লাখ টাকা,৩৭ মিটার দৈর্ঘ্যের কুকিছড়া ব্রীজ নির্মানে ব্যয়৪কোটি ৫৫লাখ টাকা, ৩৭মিটার দৈর্ঘ্যের কুরাদিয়াছড়া ব্রীজ নির্মানে ব্যয় ৪ কোটি ৫৫লাখ টাকা, একই দৈর্ঘ্যের লতিবানছড়া ব্রীজ নির্মানে ব্যয় ৪কোটি ৫৫লাখ টাকা।

একই দৈর্ঘ্য ও ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে হাটহাজারি-মাটিরাঙ্গা সড়কের খাগড়াপুর ব্রীজ, রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি সড়কে ঠাকুরছড়া ব্রীজ, মানিকছড়ি-,লক্ষীছড়ির হাতিছড়া সেতু, জালিয়াপাড়া-মহালছড়ি সড়কের সিন্দুকছড়ি সেতু ও পঙ্খিমুড়া সেতু৷

দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং সড়কের দেওয়ানছড়া সেতু নির্মান হচ্ছে ৪কোটি ৪১লাখ টাকায়, বাঘাইহাট-মারিশ্যা সড়কের পতেঙ্গাছড়া সেতু নির্মান হয়েছে ৫কোটি ১৫লাখ টাকায়, একই সড়কের নাকাপা সেতু নির্মিত হয়েছে ৪কোটি ৫৫লাখ টাকায়, দীঘিনালা-বাবুছড়া সড়কের জারুলছড়ি সেতু নির্মিত হয়েছে ৪কোটি ২৬লাখ টাকায়,মহালছড়ির চোংড়াছড়ি সেতু নির্মাণ হয়েছে ৩কোটি ৮২ লাখ টাকায়,একই সড়কে মুসলিম পাড়া ব্রীজ নির্মান হয়েছে ৩কোটি ৮২লাখ টাকায়। হেঁয়াকো-রামগড়-জালিয়াপাড়া সড়কে ৩১ মিটার দৈর্ঘ্যের পাতাছড়া সেতু নির্মাণ হয়েছে ৩কোটি ৮২লাখ টাকায়, জালিয়াপাড়া-সিন্দুকছড়ি সড়কে ২৮মিটার দৈর্ঘ্যের ধুমনীঘাট সেতু ও যৌথখামার সেতু নির্মিত হয়েছে ৩কোটি ৪৫লাখ টাক করে ব্যয়।

দীঘিনালা-বাবুছড়া-লোগাং সগকে ২৮মিটার দৈর্ঘ্যের বড়পেরা সেতু নির্মিত হয়েছে ৩কোটি ৬৮ লাখ টাকায়, খাগড়াছড়ি পানছড়ি সড়কে ২৫মুটচর দৈর্ঘ্যের ছোটনালা ব্রীজ নির্মিত হয়েছে ৩কোটি ৮লাখ টাকায়। লক্ষীছড়ি সড়কে ২৫মিটার দৈর্ঘ্যের মগাইছড়ি সেতু নির্মিত হয়েছে ৩কোটি ৬৬লাখ টাকায়, পানছড়ি সড়কে ২৫মিটার দৈর্ঘ্যের লোগাং বাজার সেতু নির্মিত হয়েছে ৪কোটি ২৩ লাখ টাকায়, একই দৈর্ঘ্যের দীঘিনালার বুজ্যেনাল সেতু নির্মিত হয়েছে ৩কোটি ৫৭ লাখ টাকায়, মগমারাছড়া সেতু নির্মিত হয়ছে ৪কোটি ৯লাখ টাকায়।

খাগড়াছি-পানছড়ি সড়কের ২২মিটার দৈর্ঘ্যের পাকুজ্জাছড়ি ব্রীজ নির্মিত হয়েছে ২কোটি ৭৫ লাখ টাকায়, মানিকছড়ি সড়কে ২২মিটার দৈর্ঘ্যের দুল্লাতলী সেতু নির্মিত হয়েছে ২কোটি ৭২লাখ টাকায়, পানছড়ি সড়কের ১৯মিটার দৈর্ঘ্যের ভাইবোনছড়া ব্রীজ ও কলাবাগান ব্রীজটি নির্মিত হয়েছে ২কোটি ৩৫লাখ টাকা করে ব্যয়ে। মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি সেতু ও তাইন্দং সেতু নির্মিত হয়েছে ১কোটি ৯৯লাখ টাকা করে ব্যয়ে।

খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কে ১৬মিটার দৈর্ঘ্যের কৃষি গবেষনা সেতু নির্মিত হয়েছে ৩কোটি ৭৬ লাখ টাকায়, দীঘিনালা সড়কের হাতিমারাছড়া সেতু নির্মিত হয়েছে ৩কোটি ৪১ লাখ টাকায়।ইতিমধ্যে সবগুলো সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। অপেক্ষা শুধু উদ্বোধনের।

খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের এক নেতা বলেন, দীর্ঘবছর আমরা ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে যানবাহন চালিয়েছি। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় বহু হতাহতের ঘটনাও আছে। অস্থায়ী সেতুর পাটাতনে ভেঙ্গে গাড়ি আটকে যান চলাচর বিগ্ন হতো। এখন সেসবের পরিবর্তন হয়েছে। যে কয়েকটা ঝুকিপূর্ণ ছিল সেগুলোও স্থায়ী সেতুতে রুপান্তরিত হলো। এটি খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোহে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।

নারী উদ্যোক্ত ও সাম্পারি গ্রুপ অব ইনেসিয়েটিভ’র চেয়ারপার্সন শাপলা দেবী ত্রিপুরা বলেন, আশির দশকে সাময়িক সময়ের জন্য নির্মিত অস্থায়ী ব্রীজগুলো দিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর জেলাবাসী যাতায়াত করেছে কত দুর্ঘটনা ঘটেছে, কত প্রাণহানি হয়েছে তার হিসেব নেই। সেতুগুলো নির্মাণ হওয়ায় পর্যটকদের ভ্রমন নিরাপদ হয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাজেকে যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। তাই নিরাপদ যান চলাচলের জন্য স্থায়ী সেতু নির্মাণ খুবই প্রয়োজন ছিল।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুজন চাকমা বলেন, আগে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে অধিকাংশ সড়কে অস্থায়ী বেইলী ব্রীজ ছিল। ব্রীজের পাটাতন খুলে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটতো। আবার মেরামত করে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে কখনো কখনো এক থেকে দুইদিন লাগতো। এতে স্থানীয়দের কৃষিপণ্য পরিবহন, অসুস্থ রোগী পরিবহনসহ সাধারণ জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্থ হতো। তবে এখন এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে জেলাবাসী। এন সব স্থায়ী সেতু। তাই যান চলাচলে আগের মত বিগ্ন ঘটেনা।

খাগড়াছড়ি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কংজরী চৌধুরী বলেন, খাগড়াছড়ি কৃষি নির্ভর এলাকা। এখানকার উৎপাদিত কৃষি পণ্য সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। স্থায়ী সেতু হওয়ায় এখন ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তা মুক্ত থেকে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। যা সামগ্রিক অর্থে জেলাবাসি আত্মসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভুমিকা রাখবে। এটি সরকারের সুদূর প্রসারি চিন্তার ফসল।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সারাদেশের মত খাগড়াছড়িতে সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তৎকালীন বেইলী সেতু দিয়ে সড়কে যান চলাচল করতে কখন যাত্রীসহ সেতু ভেঙ্গে যায় এই ভয়ে আমরা আতংকে থাকতাম। এখন জেলা-উপজেলার সাথে একদম নিরাপদ নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য জেলাবাসীর পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, আমরা জেলার ৪২টি সেতু নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেছি। আগামী ৭ নভেম্বর সেতুগুলোর উদ্বোধনের সময় চুড়ান্ত করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এ প্রেসাগ্রাম অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি জানান।

তিনি আরো জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি সারাদেশের ১০০টি সেতুর সাথে খাগড়াছড়ির ৪২টি উদ্বোধন করবেন। তার মধ্যে খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগের আওতায় ৪২টি সেতুর ৪১টি খাগড়াছড়ি জেলায় অন্যটি ১টি রাঙ্গামটি জেলায় এবং ৭২টি সেতুর ব্যায় ১৮৩.৬০ কোটি বলেও জানান তিনি। এছাড়াও স্থানীয়দের যেমন দুর্ভোগ কমেছে তেমনি জেলায় জীবনমান উন্নয়নসহ পর্যটনখাত সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। উল্লেখ্য, এর আগে ১শ ৪৩কোটি টাকা ব্যয়ে জেলায় ১৮টি স্থায়ী সেতু খাগড়াছড়ি-ঢাকা ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন এনেছে।

By admin

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!