পারভেজ হায়দার॥
লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিনই হতে যাচ্ছেন পরবর্তী সেনাপ্রধান। যৌক্তিক এবং প্রত্যাশিত ভাবেই সরকার তার মেধা আর নেতৃত্বের গুনাবলীর উপর আস্থা রেখেছে। জেনারেল শফিউদ্দিনের ঈর্ষনীয় ক্যরিয়ার প্রোফাইল তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। গত ১০ জুন ২০২১ তারিখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় কর্তৃক জারিকৃত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদকে আগামী ২৪ জুন বিকাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জেনারেল পদে পদোন্নতি প্রদানপূর্বক তিন বছরের জন্য সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন এবং তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬তম সেনাপ্রধান হতে চলেছেন। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ২৪ জুনে অবসরে যাচ্ছেন। চলুন জেনে নেই নতুন এই সেনাপ্রধানের জীবনের কিছু অজানা তথ্যঃ-
লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ১৯৬৩ সালের ০১ ডিসেম্বর খুলনা শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম শেখ মোঃ রোকন উদ্দীন আহমেদ ছিলেন একজন অধ্যাপক, সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৮০ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নির্বাচিত জন প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় খুলনাবাসীর জন্য নানাভাবে জনহিতকর কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় মৃত্যুর পর তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন স্বরূপ খুলনাবাসী তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করে, যা ‘প্রফেসর রোকনউদ্দিন সড়ক’ নামে পরিচিত।
শিক্ষাবিদ পিতার সন্তান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের মেধার আলোকছটা প্রকাশ পেয়েছিল সেই ছাত্র জীবন থেকেই। সেন্ট জোসেফ স্কুল এবং স্বনামধন্য একটি ক্যাডেট কলেজে অধ্যয়নের সময় তার কৃতিত্ব ছিল চোখে পড়ার মত। তিনি ২৩ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবম দীর্ঘমেয়াদী কোর্সের সাথে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। তিনি তার কোর্সের মেধা তালিকায় প্রথম কর্মকর্তা হিসাবে অবস্থান করে উজ্জ্বল বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের আগাম বার্তা জানিয়ে ছিলেন।
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। তখন তার ইউনিট পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশনে নিয়োজিত ছিল। আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল উত্তপ্ত, ছিল শান্তি বাহিনীর ঝটিকা আক্রমন আর পাহাড়ী-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সংঘাতে পরিপূর্ণ, সব মিলিয়ে বিভিষিকাময় ঐ প্রেক্ষাপটে তার কর্মজীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জনের পর দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কোর্সে অসাধারণ সাফল্যের কারণে পরবর্তী কর্মজীবনে উন্নতির শিখরে উঠতে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
জেনারেল শফিউদ্দিনের মেধা আর নেতৃত্বের গুনাবলীর কারণেই চাকুরীর বিভিন্ন স্তরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, একটি পদাতিক ব্রিগেড ও একটি পদাতিক ডিভিশন কমান্ড করা সহ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে মাল্টিডিম্যানশনাল ফোর্সের ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালনে পারদর্শিতা প্রদর্শন করে সকলের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন।
কর্মদক্ষ এই অফিসার ২০১২ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হিসেবে দায়িত্ব নেন। সেই সময় তিনি বেসামরিক প্রশাসনের সাথে যমুনা নদীর ভাঙ্গন রোধ ও জামালপুরে বাঁধ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ঐ সময় বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি, সন্ত্রাসবাদসহ নানা বিষয়ে গবেষনাধর্মী কাজ করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন; তখন অনেকেই তাকে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ‘থিংক ট্যাংক’ বলে মনে করত।
তিনি লজিষ্টিক এরিয়া কমান্ডার হিসাবেও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মেধা, সততার সাথে ব্যাপক অবদান রাখেন। মেজর জেনারেল পদবীতে তিনি ২০১৪-২০১৬ সাল পর্যন্ত সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এ ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপদসংকুল এলাকায় অসামান্য কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের জন্য দুইবার মিশনের সময়সীমা বর্ধিতসহ Special Representative of the Secretary General (SRSG) [মিশন প্রধান] কর্তৃক সাইটেশন প্রাপ্ত হয়েছেন। এই মিশনে অবস্থানকালে ০৯ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে তাকে অ্যাম্বুশে পড়তে হয়েছিল, তবে তিনি তার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা ও সময়োচিত সিদ্ধান্তের কারণে সেসময় রক্ষা পান। ইতিপূর্বে তিনি ১৯৯৩-১৯৯৪ সালেও মোজাম্বিকে শান্তিরক্ষী মিশনে ১৬ মাস সফলতার সাথে বিদেশের মাটিতে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ও সম্মান বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন।
পেশাগত ক্ষেত্রে সফলতার পাশাপাশি জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন বিভিন্ন প্রফেশনাল ডিগ্রি ও জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিভা ও মেধার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডিফেন্স স্টাডিজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন।
এছাড়া তিনি দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ অত্যন্ত সুনামের সাথে সম্পন্ন করেছেন। তিনি ২০১০ সালে চীনের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি (এনডিইউ)’তে ডিফেন্স এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এ অসামান্য কৃতিত্বের সাথে মাষ্টার্স সম্পন্ন করেন। তার Individual Research Paper টি Outstanding Research Paper হিসেবে পুরস্কৃত এবং NDU, China এর ম্যাগাজিন Defence Forum এ প্রকাশিত হয়।
National Defence University, China এর ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাংলাদেশী অফিসার যিনি ৪৮টি দেশের ৭৮ জন অফিসারের ভিতর প্রথম স্থান অধিকার করেন। National Defence University, China এর ইতিহাসে সরাসরি ভোটে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে Student Group এর সভাপতিও নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্টের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে North East South Asia Center (NESA) কর্তৃক আয়োজিত এক্সিকিউটিভ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ঘঊঝঅ এর গ্রাজুয়েট হিসাবে সম্মানিত হন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবিএ ডিগ্রীতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জনসহ গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত হন। এরপর অসামান্য ফলাফলসহ ডেভলপমেন্ট এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজে এম. ফিল সম্পন্ন করেন। জেনারেল শফিউদ্দিন বর্তমানে বিইউপিতে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত আছেন। তিনি তার কর্মজীবনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়াদি, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা এবং ডিফেন্স এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সম্পর্কিত বিভিন্ন সেমিনার, সম্মেলন, কর্মশালা ইত্যাদিতে অংশ নিয়েছেন।
দেশ ও বিদেশের স্বনামধন্য জার্নালে তার আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। খুলনাবাসীর গর্ব জেনারেল শফিউদ্দিন এখন সারা বাংলাদেশের গর্ব; তার হাত ধরেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবহিনী পেশাদারিত্বের উৎকর্ষতা অর্জনে উচ্চ স্থানে থাকবে, এই প্রত্যাশা সকলের।