উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটে পাহারের ১২ লাখ মানুষের জীবন
নিজস্ব প্রতিবেদক:: সীমান্ত পথ দিয়ে দেশের ভেতর প্রবেশ করা বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকদ্রব্যে ছেয়ে গেছে তিন পার্বত্য জেলা। পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও গোপনে গড়ে তোলা হয়েছে অস্ত্রের আখড়া। ভারতীয় নাগরিক ও গোলাবারুদ বাংলাদেশে আসছে অবাধে। ত্রিপুরা রাজ্যের উপজাতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে, স্থায়ীভাবে বংশবিস্তার করে, উপজাতীয়দের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার জলজেন্ত প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি আদিবাসী শব্দ বির্তকের ঘটনায়।
বাংলাদেশ-ভারত মিয়ানমারের অরক্ষিত সীমান্ত পথে সম্প্রতি সেনাবাহিনীর ৮৪ ক্যাম্প প্রত্যাহারের ফলে আগ্নেয়াস্ত্র, মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৫১ সেনাক্যাম্প, ১টি ব্রিগেড, ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন সম্পূর্ণ তুলে নেয়ার ঘোষণায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পার্বত্যবাসী। কারণ বর্তমানেও রয়েছে অরক্ষিত সীমান্ত পথ। যদি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয় তাহলে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে তিন পার্বত্য জেলা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৬৫ কিলোমিটার সীমান্তে বিজিবি ক্যাম্প না থাকায় এবং সেনাবাহিনীর ৮৪টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়ায় মাফিয়াচক্র পার্বত্য এলাকার অরণ্য পথে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দেশের ভেতরে সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে সহজে পৌঁছে দিচ্ছে। পাহাড়ি এই দুর্গম এলাকা আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওই এলাকায় হেরোইন তৈরির পপি চাষও হচ্ছে।
পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পালাক্রমে প্রহরা বসিয়ে সেখানে আফিম, পপি, গাঁজা চাষ করছে। সেনাবাহিনী এবং বিজিবি বান্দরবান সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় বিভিন্ন সময় এসব পপি ও গাঁজা চাষের বাগান ধ্বংস করেছে। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, তবলছড়ি, মহালছড়ি ও লক্ষীছড়ি, রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর এলাকায়ও গাঁজা চাষের বাগান ধ্বংস করা হয়। বর্তমানে আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত পথ দিয়ে হেরোইন, ফেনসিডিল, বিয়ারসহ বিভিন্ন মদ দেশের ভেতরে প্রবেশ করছে। সীমান্ত পথে আসা মাদকদ্রব্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী এবং ঢাকায়ও চালান হচ্ছে এসব মাদকদ্রব্য। একই পথে দেশের ভেতরে অস্ত্রও প্রবেশ করছে। এসব আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন উপজাতীয় সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি গেরিলা বাহিনী রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পক্ষ-বিপক্ষে গ্রুপগুলোর কাছে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর শান্তিবাহিনীর ১৯৪৭ জন সদস্য সহস্রাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। পার্বত্য জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমার নেতৃত্বে শান্তি বাহিনীর গেরিলা জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু কিছুদিন পর আবার ইউপিডিএফ নামে একটি সংগঠন চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিলেও গোপনে গড়ে তুলছে বিশাল গেরিলা বাহিনী। যাদের কাছে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ রয়েছে। এসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র তারা ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত পথ দিয়ে সংগ্রহ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে পার্বত্যবাসীকে জিম্মি করে রেখেছে। এ কারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২ লাখ মানুষের জীবন।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১ হাজার অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা এসব অস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হবে এমনটিই আশা করেছিল পার্বত্যবাসী। তাই পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন এবং পাহাড়ের অস্থিতিশীল অবস্থা দূর করতে দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করেন এখানকার অধিবাসীরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের পর পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখতে চায় এখানকার অধিবাসীরা। কারণ দুই দশকের গেরিলা সন্ত্রাসী বাহিনীর কর্মকান্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম অনেক দূর পিছিয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের গোপন পথে গেরিলাদের হাতে যাচ্ছে। এসব অস্ত্র ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের প্রবেশ মুখে প্রতিদিন সেনাবাহিনী তল্লাশি অভিযান অব্যাহত রেখেছে। মাঝে মধ্যে পাচারকৃত ও অবৈধ অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য ধরাও পড়ছে। পাচারকৃত অস্ত্রের তালিকায় রয়েছে এসএমজি, এলএমজি একে-৪৭ রাইফেল, একে-৪৬ রাইফেল, এম-১৬ রাইফেল, পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেল, পাইপগান, এলজি, রিভলবার, নাইন এসএল, সাধারণ বন্দুকসহ বিভিন্ন বিস্ফোরক দ্রব্য।
সম্প্রতি দীঘিনালা, বাঘাইছড়ির বাঘাইহাট, মারিশ্যাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়। এসব অস্ত্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যসহ পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে অস্ত্রের চালান আসে উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ ও জেএসএম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ব্যবহার করে থাকে। এই নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে চোরাচালান ও ভারতীয় নাগরিক অনুপ্রবেশ বন্ধ করার বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার প্রত্যাশা করছে পার্বত্য অঞ্চলের সচেতন মহল।