কলেজ কমিটির অবহেলা
নুরুল আলম:: টানা তিন বছর কোনো বেতন-ভাতা পাননি বান্দরবান জেলার থানচি কলেজের ৮ জন শিক্ষক। ধাপে ধাপে বেতন পেলেও ৩৭ মাস ধরে বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন শিক্ষকরা। বেতন-ভাতা না পেয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরমভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। আছে অবহেলা আর বঞ্চনার কথা।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে থানচি কলেজ স্থাপিত হয়। এরপরই বিভিন্ন দুর্গম এলাকা থেকে ভর্তি হতে থাকে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা। সেসব শিক্ষার্থীদের নিয়ে কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে কলেজে অধ্যক্ষসহ শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১৩ জন আর কর্মচারী ৫ জন। বর্তমানে কলেজে অধ্যক্ষসহ ৯ জন শিক্ষক উপস্থিত রয়েছে। বর্তমানে আটজন শিক্ষক বিনা বেতনে ১৩৫ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাচ্ছেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুতে ৫ বছর ধাপে ধাপে বেতন পেলেও পরবর্তীতে বেতন বন্ধ হয়ে যায়। এ পর্যন্ত তারা আর কোনো বেতন-ভাতা পাননি। গত ৩৭ মাস শূন্য হাতে প্রতিদিন অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন শিক্ষকরা। এ অবস্থায়ও তারা ক্লাস, পরীক্ষা যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। তবুও আগামী ৩০ জুন এই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পৃথক বেতন স্কেল চালু তো দূরের কথা, অনেক শিক্ষক এখনও ঠিকমতো বেতনই পান না। আবার কয়েকজন শিক্ষক বেতন না পাওয়াই কলেজের চাকরি বলবৎ রেখে অন্যস্থানে চাকরি শুরু করেছে। কোন কোন শিক্ষক বেতন না পাওয়ার কারণে ক্লাস নেওয়া তো দূরের কথা বিদ্যালয়ে আসেন না। তাছাড়া কলেজের মধ্যে সেসব শিক্ষকদের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা বৈষম্য। শুধু তাই নয়, কলেজের পাশে নতুন ভবনের কাজ শেষ করা এবং শিক্ষকদের বেতন পাওয়ার বিষয়ে কোন উদ্যেগ না নেয়ার পাশাপাশি নিজের ইচ্ছে মতো বিদ্যালয় পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে থানচি কলেজের অধ্যক্ষ দমিনী ত্রিপুরা বিরুদ্ধে।
অভিযোগ আছে, থানচি কলেজের অধ্যক্ষ দমিনী ত্রিপুরা যোগসাজশে কারণে নিয়োগ প্রাপ্ত নতুন শিক্ষকদের কলেজের অনুপস্থিত থাকা শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সুযোগ দিয়েছেন। ফলে সেসব শিক্ষকরা কলেজের শুরু থেকে অনুপস্থিত। তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, থানচি বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার ভিতরে ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন দুই তলা বিশিষ্ট ভবন থানচি কলেজ। সেখানে ব্যবসা ও মানবিক শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকরা। সেই আটজন শিক্ষকদের হাজিরা খাতায় প্রতিদিন উপস্থিত রয়েছেন। কলেজের পাশের আরেকটি নতুন ভবনের কাজ চলমান। তবে দীর্ঘ সময় পার হলেও ভবনের কাজ হয়েছে মাত্র এক শতাংশ। চারিপাশে ভবনের পিলার ছাড়া আর কিছুই নেই।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক কলেজের কয়েকজন শিক্ষক জানান, কারো ২৬ মাস কারো ৩৭ মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। তবুও আমরা নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছি। নিজেদের টাকা খরচ করে কলেজে আনুষাঙ্গিক জিনিস কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। ধাপে ধাপে বেতন পেলেও দীর্ঘ সময় বেতন বন্ধ থাকায় আমাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
নতুন নিয়োগকৃত থানচি কলেজের শরীর চর্চার শিক্ষক উচসিং মারমা বলেন, গত বছরের কলেজের সার্কুলেশনের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছি। তারপর থেকে এখনো বেতন-ভাতা পায়নি। আর নতুন নিয়োগে সময় যারা ছিল তাদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে দেখা যায়না । তবুও ধার-দেনা করে নিয়মিত পাঠদান দিয়ে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে থানচি কলেজে অধ্যক্ষ দমিনী ত্রিপুরা বলেন, গত ডিসেম্বর মাসের কলেজের এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র অনুমোদনের জন্য শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫শত টাকা, শিক্ষক-কর্মচারীদের নিকট থেকে ২ লাখ ১৪ হাজার ৫ শত টাকাসহ মোট ৬ লাখ টাকার এফডিআর ও জেনারেল ফান্ডে জমা দেয়ায় আর্থিক সংকট হয়েছে। এর আগে প্রতিষ্ঠানকালীন সময়ের পাঠদানের অনুমোদন, জমি সংক্রান্ত বিষয়ে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ক্যহ্লাচিং মারমা ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৪১৯ টাকা দিয়েছেন। আমি নিজ থেকে ১ লাখ ১৬ হাজার ২০০ টাকা খরচ করেছি।
বাকি তিন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অধ্যক্ষ বলেন, ২০২৩ সালে ৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। বেতন দিতে না পারায় তারা এখনো যোগদান করেননি।
থানচি কলেজের নতুন ভবন নির্মাণ কাজ থেমে থাকার বিষয়ে জেলা শিক্ষা প্রকৌশলী বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নতুন করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। তবে বিস্তারিত জানতে চাওয়ার আগে তিনি ফোন কেটে দেন।
থানচি উপজেলার চেয়ারম্যান ও কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি থোয়াইহ্লা মং মারমা বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বরাদ্দ পেলে তারপর শিক্ষকদের মাঝে বেতন-ভাতা দেয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া শিক্ষার্থী কম ও এমপিও ভুক্ত না হওয়ার কারণে কিছু বিঘ্ন হতে পারে। আর শিক্ষক নিয়োগের টাকা নেয়ার বিষয়ে আমি অবগত নই।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ফরিদুল আলম বলেন, বিষয়টি শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ বা কমিটি চাইলে যে কোন সংস্থা থেকে সাহায্যে নিতে পারে। তবে সেটি সেই শিক্ষক এবং কমিটি মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের শিক্ষা অফিস থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগী করা চেষ্টা করব।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, কি সমস্যা হয়েছে সেই বিষয়ে তদন্ত না করে ত বলা যায় না, তবে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করা হয়েছে।