শিরোনাম
মঙ্গল. ডিসে ২৪, ২০২৪

নুরুল আলম:: রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটি বাংলাদেশের অন্য ৬১টি জেলার চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। ‘শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন’ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনা সদস্যবৃন্দ নিরীহ পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা রক্ষায় তৎপর রয়েছে।

দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী বুকের রক্ত দিয়ে হলেও দেশের স্বাধীনতা ও ভূখন্ডের অখন্ডতা রক্ষা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য বদ্ধপরিকর। শান্তি চুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কার্যক্রম, খাদ্য সমস্যা নিরসন, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত স্থানীয় ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা, দরিদ্র ব্যক্তিদের স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দুর্গম এলাকায় পানির কষ্ট লাঘবে সুপেয় পানির ব্যবস্থা এবং বেকার ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র কারখানা স্থাপন করে আসছে।

পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত। তবে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সম্পর্ককে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে বিভিন্ন মহলে উত্থাপন করার অপপ্রয়াস চালায়। সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সময়ের আবর্তে নানাবিধ কারণে অনেকটা বিনষ্ট হয়েছে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সেনাবাহিনী নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করছে, যা পাহাড়ি-বাঙালিদের সম্পর্ক উন্নয়নে প্রভূত সফলতা বয়ে নিয়ে এসেছে। যেমন- জাতীয় সকল দিবসে সেনাবাহিনী এবং জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে পাহাড়ি-বাঙালিদের মিলনমেলার আয়োজন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিরাপত্তার সঙ্গে পালনে সহায়তা, সেনাবাহিনী কর্মকর্তাদের উপস্থিতি এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাহাড়ি-বাঙালিদের আমন্ত্রণ, যা সার্বিকভাবে পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গঠনে ভূমিকা রাখে।

পাহাড়ি-বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে পাড়া, মৌজা, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং সবশেষে জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন, জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তা ধারণ ও চর্চার উদ্দেশ্যে পাহাড়ি-বাঙালিদের সম্পৃক্ততায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দুর্গম পার্বত্য এলাকার জনগণের সুষ্ঠু বিনোদনের জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক বিগত বছরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের পাশাপাশি উন্মুক্ত চলচ্চিত্রও প্রদর্শন করা হয়।

সেনাবাহিনীর সার্বিক অর্থায়নে সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালি ছেলেমেয়েদের সুকোমল মনোবৃত্তির চর্চায় আগ্রহী করে তোলায় সেনাবাহিনী কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্কুলের স্বল্পতা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণেও অনেকেই শিক্ষা গ্রহণ কার্যক্রমের বাইরে থেকে যায়। সার্বিক পরিস্থিতি হতে উত্তরণের মাধ্যম হিসেবে সেনাবাহিনীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং অর্থায়নে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়েই অনেক ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের স্কুল (দিবা ও নৈশ) পরিচালনা করে থাকে।

সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো থেকে শুরু করে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, বই বিতরণ, শিক্ষাসামগ্রী প্রদান, ছাত্র-ছাত্রী পরিবহন, আর্থিক অনুদান, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন শিক্ষাসামগ্রী, ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল ড্রেস ও খেলাধুলার সামগ্রী বিতরণ করে সর্বদা স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেনাবাহিনী প্রতিবছরই শিক্ষাকে সর্বাগ্রে নিয়ে আসা, সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ মানসম্মত ও কর্মঠ শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরার জন্য শিক্ষা সেমিনারের আয়োজন করে।

এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের মেধার বিকাশ ও জ্ঞানের নানামুখী চর্চায় সুযোগ্য মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য আন্তঃস্কুল বিতর্ক, বানান ও কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সেনাবাহিনী। সেনা রিজিয়ন/জোন কর্তৃক পরিচালিত কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাহাড়ি-বাঙালি প্রশিক্ষণার্থী কম্পিউটার প্রশিক্ষণে দক্ষতা অর্জন করেছে, যা তাদের কর্মসংস্থান বা চাকরি পেতে সহায়তা করছে।

সর্বোপরি, পিছিয়ে পড়া জনপদের মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়া সমুন্নত করা এবং সকলের নিকট সর্বোচ্চ সুবিধা পৌঁছে দেওয়াও সেনাবাহিনী কর্তৃক সম্পাদিত কার্যসমূহের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য।

পার্বত্য দুর্গম এলাকাগুলোতে চিকিৎসার অভাবে দিনাতিপাত করা মানুষের পাশে সব সময়ই দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতিবছর নিয়মিতভাবে পার্বত্য তিন জেলায় বিনামূল্যে চক্ষুশিবির পরিচালনা করে পার্বত্য এলাকার সুবিধাবঞ্চিত বয়োবৃদ্ধ পাহাড়ি ও বাঙালির চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের চক্ষুসেবা প্রদান করা হয়।

গুইমারা রিজিয়ন সেনাবাহিনীর চিকিৎসকের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী পীড়িত উপজাতি ও বাঙালিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। জন্মকালীন মৃত্যুরোধে সেনাবাহিনী কর্তৃক ধাত্রী প্রশিক্ষণ প্রদানের আয়োজন পার্বত্য তিন জেলায় মা ও শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে দিয়েছে, যা ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ অর্জনে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে।

করোনায় যখন সারাদেশের মানুষ নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটির দুর্গম অঞ্চলের মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং জনস্বার্থমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চিকিৎসাসেবায় সেনাবাহিনীর এই সহায়তা সব সময় চলমান রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে।

সরকারের নির্দেশনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাহাড়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে হাতে নিয়েছে নানা পরিকল্পনা। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্যাঞ্চলে দিনরাত পরিশ্রম করে রাতারাতি সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৫৩২ কিমি নতুন রাস্তা তৈরি, ভূমিধস বা অত্যধিক বৃষ্টিতে ভেঙে পড়া রাস্তা মেরামত, যাতায়াতের সুবিধার্থে ছোট ছোট নদী ও খালের ওপর সেতু ও সাঁকো তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে।

বাংলাদেশের সর্বাধিক উচ্চতাবিশিষ্ট থানচি-আলীকদম সড়ক, বাঙ্গালহালিয়া-রাজস্থলী সড়ক, বাঘাইহাট-সাজেক সড়ক, বান্দরবান-বাঙ্গালহালিয়া-চন্দ্রঘোনা-ঘাগড়া সড়ক প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মাণ করা হয়েছে। রাজস্থলী-ফারুয়া-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি-বরকল সড়কটিও সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মাণের প্রক্রিয়াধীন আছে। তিন পার্বত্য জেলার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকাকে নজরদারির আওতায় আনা ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ও উপজাতি সন্ত্রাসীদের প্রতিকূল অবস্থান মোকাবিলা করে ১০৩৬ কিমি দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক (খাগড়াছড়ির রামগড়ের ফেনী নদীর কূল হতে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক, বরকল, বিলাইছড়ি হয়ে বান্দরবানের রুমা, থানচি, আলীকদম, নাইক্ষংছড়ির ঘুমধুম, টেকনাফ) নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দায়িত্ব পালন করছে।

পার্বত্যাঞ্চলের উপরোক্ত সীমান্ত সড়কপ্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন হবে। এছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, সীমান্ত এলাকার কৃষিপণ্য দেশের মূল ভূখন্ডে পরিবহনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

পার্বত্যাঞ্চলে সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনী স্থানীয়দের সমবায় সমিতির মাধ্যমে গভীর নলকূপ স্থাপনে সহায়তা করছে। এতে বিভিন্ন এলাকা একদিকে যেমন সেচের আওতায় আসছে, অন্যদিকে স্থানীয়দের খাবার পানির অভাব দূর করছে। পার্বত্যাঞ্চলের পানি ও বিদ্যুৎ আসার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে কৃষিকাজ। বেড়েছে চাষাবাদ। প্রান্তিক চাষিগণ প্রত্যন্ত এলাকা হতে বিভিন্ন উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও ফলফলাদি পরিবহনে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নে অবদান রাখছে। এছাড়াও বনসম্পদ রক্ষাকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজ ব্যবস্থাপনায়, আবার কখনো বিভিন্ন এনজিও ও স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বয়ের মাধ্যমে পর্যাপ্ত বনায়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।

পর্যটনের জন্য পার্বত্য ভূখ- বরাবরই আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও যোগাযোগ ও আবাসন সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকায় তিন পার্বত্য জেলায় এ সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। সরকারের আহ্বানে তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানোর লক্ষ্যে সেনাবাহিনী কর্তৃক যোগাযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও রাত্রিযাপনের সুবিধা তৈরি হওয়ায় এখন হাজার হাজার সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছেন।

সাজেক, নীলগিরি, কাপ্তাই লেকের পাশে রিসোর্ট নির্মাণ এসব পদক্ষেপের উল্লেখযোগ্য দিক। আলুটিলা, বগা লেক, স্বর্ণ মন্দির, চিম্বুক হিল, শুভলং জলপ্রপাত প্রভৃতি পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী পর্যটন শিল্প বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার ফলে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

পার্বত্য অঞ্চলের হতদরিদ্র পাহাড়ি-বাঙালি মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এতে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি-বাঙালি নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

সেনা ক্যাম্পের সন্নিকটে অথবা উপজেলার সুবিধাজনক স্থানে সেনাবাহিনী হতদরিদ্র পাহাড়ি-বাঙালি মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার প্রয়াসে কম্বল ও ব্যাগ ফ্যাক্টরি, কুটির শিল্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে অনেক পাহাড়ি-বাঙালি মহিলাকে চাদর, থামি, লুঙ্গি ও গামছা তৈরির প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে।

এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন তাঁত তৈরি ও কাঁচামাল ক্রয় বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করা হয়। বিভিন্ন গুচ্ছগ্রামে মহিলাদের কর্মসংস্থান তৈরিতে উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে মুরগির ফার্ম পরিচালনা ও এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, মাশরুম, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল চাষের প্রশিক্ষণ ও প্রত্যক্ষ সহায়তা প্রদান করায় তাদের পারিবারিক ভরণপোষণ ক্ষমতা ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাহাড়ে সন্ত্রাস দমনে ও শান্তি রক্ষায় সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর। এক সময় তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি সন্ত্রাসী দলগুলোর পাল্টাপাল্টি হামলা ও খুনোখুনির কারণে ভয় নেমে আসত সেখানকার বসবাসরত সাধারণ মানুষের ভেতর। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে সরকার ও সেখানকার আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কমে এসেছে চাঁদাবাজি।

বেড়েছে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি। আগে যেখানে দিনেদুপুরে গাড়ি থামিয়ে, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে, অপহরণ করে বিরাট অঙ্কের চাঁদাবাজি হতো. সেখানে তা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, আগে সন্ত্রাসীদের ভয়ে পাহাড়ি সড়কে বিকাল ৫টার পর কোনো যানবাহন চলাচল না করলেও বর্তমানে ২৪ ঘণ্টাই বিলাসবহুল গাড়ি চলাচল করছে, যা শান্তি চুক্তির অভাবনীয় সাফল্য। এসব অপকর্ম থেকে পাহাড়ের পাহাড়ি-বাঙালি মানুষকে শান্তিতে রাখতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে দিনরাত অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি সেনাবাহিনী পাহাড়ে বসবাসরত লোকজনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নমূলক নানা প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে। নানাবিধ ভৌত ও কাঠামোগত উন্নয়ন, সচেতনতামূলক কার্যধারা ও কল্যাণময় কার্যক্রমের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিদের হৃদয় ও মন জয় করে নিয়েছে।

সেনাবাহিনীর ৪টি জোনের দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় সেনাবাহিনী অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারিগরি প্রতিষ্ঠান, অসংখ্য হতদরিদ্র পাহাড়ি-বাঙালিকে ঘর নির্মাণে সহায়তা প্রদান করেছে। মসজিদ ও কিয়াংঘর নির্মাণসামগ্রী প্রদান, মাইক প্রদান, মেঝে পাকা করা, বিভিন্ন পূজা-পার্বণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের নিমিত্তে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থাকরণের মাধ্যমে নিকট বন্ধুতে পরিণত হয়েছে সেনাবাহিনী।

সম্প্রীতি বজায় ও সামাজিক উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ধর্মের মানুষের কাছে সেনাবাহিনী একটি নির্ভরতার প্রতীক। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখন নিতনৈমিত্তিক ঘটনা। ২০১৭ সালের ১৩ জুন অতিবৃষ্টির ফলে রাঙ্গামাটির মানিকছড়িতে ভয়াবহ পাহাড়ধসে উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালীন পাহাড়ের একটি বড় অংশ উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের ওপর ধসে পড়ে।

এতে ঘটনাস্থলেই মেজর মোহাম্মদ মাহফুজ ও ক্যাপ্টেন তানভীরসহ ৩ সেনাসদস্য নিহত এবং ১০ সেনাসদস্য গুরুতর আহত হন। দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর বেশকিছু সদস্য পাহাড়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সশস্ত্র আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অনেক সেনাসদস্য। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে এসে আজ অবধি অনেক সেনাসদস্য মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়ে, সাপের কামড়ে কিংবা বন্য জন্তুর আক্রমণে নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।

শান্তি চুক্তির পর বর্তমান সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী তাদের সীমিত সম্পদ ও জনবল দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসন ও জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সেনাবাহিনী যে ভূমিকা রাখছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি এবং যথাযথ ভূমিকার কারণে পর্যায়ক্রমে নিরাপত্তা পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েনের পর হতে পাহাড়ি জনপদে এসেছে উন্নয়ন ও প্রাণের স্পন্দন। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে, বাজার অর্থনীতি এবং বিপণন সফলতার মুখ দেখেছে, স্বাস্থ্যসেবায় সূচক উন্নত হয়েছে, চাষাবাদ বেড়েছে, জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে এবং কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার কমেছে। সর্বোপরি, সামাজিক সকল সূচকই ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি পাহাড়ি জনপদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!