পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়ে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা
নিজস্ব প্রতিবেদক:: পার্বত্য চট্টগ্রামে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। স্থানীয় চারটি সশস্ত্র সংগঠন চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত তাদের কৌশল পরিবর্তন করছে। আগে তারা সশরীরে চাঁদার অর্থ সংগ্রহ করত। কিন্তু গ্রেপ্তারের ঝুঁকি থাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে বর্তমানে চাঁদার অর্থ লেনদেন করে থাকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। এ কারণে তাদের গ্রেপ্তার করাটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজির বিষয়ে ভুক্তভোগী কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না। কারণ কথা বললেই প্রাণ হারানোর ভয় তাড়া করে চাঁদাবাজির শিকার পাহাড়ে বসবাসরত মানুষদের মধ্যে। চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে গত ২০১৯ সাল থেকে ২০২৫ জানুয়ারী পর্যন্ত ২১৫টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে পাবর্ত্য ৩ জেলায়। এসব হত্যাকান্ডের বরাবরই উঠে এসেছে পাহাড়ে সক্রিয় চারটি সশস্ত্র সংগঠনের নাম। কিন্তু তাদের অপতৎপরতা বন্ধ হয়নি। চাঁদাবাজিও থামছে না। হত্যাকান্ড, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডসহ সশস্ত্র চার সংগঠনের নানা অপতৎপরতার কারণে শান্তি চুক্তির ২৭ বছরেও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। বরং নতুন করে অশান্তির বীজ বপনের চেষ্টা চলছে। এ কারণে কাটছে না পাহাড়বাসীর আতঙ্ক। পাহাড়ে নতুন করে সশস্ত্র সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নেমেছে। চাঁদার অর্থসহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে সশস্ত্র সংগঠনগুলো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে খুনোখুনি করছে। স্থানীয় প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ২০১৪ সাল থেকে এযাবৎ ৪৫০ জন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অপহরণের শিকার হয়েছে ৭৩২ জন। ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নয় মাইল এলাকায় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গাড়িতে জেএসএস (মূল) এবং ইউপিডিএফ (মূল) সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় ৮ জন নিহত হয়। ওই হামলায় মোট ১৮ জন নিহত হন।
২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের রাজভিলা ইউনিয়নের জামছড়িতে জেএসএসের (মূল) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বাচানু মারমাকে গুলি করে হত্যা করে। ২০১৯ সালের ২২ মে বান্দরবানের সাবেক পৌর কাউন্সিলর চাইথোয়াইমং মারমাকে উজিমুখপাড়া এলাকায় তার নিজ খামারবাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়। পরে ২৫ মে শিকল খালের আগা নামক স্থান থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নামে আঞ্চলিক সংগঠন ছিল। সেটি ভেঙে তিনটি আঞ্চলিক সংগঠন জন্ম লাভ করে। এগুলো হলো- জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (প্রসীত খীসা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। বর্তমানে এই চারটি সংগঠন পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে রয়েছে। প্রায় সব হত্যাকান্ডের সঙ্গে উঠে আসে এই চার সংগঠনের অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের নাম। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ অধিক চাঁদাবাজকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ সময় চাঁদাবাজির প্রায় ৭০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং ২ লাখ ৪৭ হাজার ভারতীয় রুপি জব্দ করা হয়। তিন পার্বত্য জেলায় প্রচলিত আছে, বাজারে যাই বিক্রি করা হোক সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক চাঁদা হিসেবে সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে দিতে হয়। অনেকে বলে থাকেন, কাঠ থেকে শুরু করে একটি কলার ছড়ি বিক্রি করলেও সেখান থেকেও চাঁদা দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাহাড়ে সংঘটিত অপরাধের ঘটনায় পাহাড়ে বসবাসকারী ভুক্তভোগী মানুষের থানাপুলিশের দ্বারস্থ হওয়ার আগ্রহ কম। বিশেষ করে উপজাতিরা তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রথাগতভাবে অপরাধের বিচারের পথে হাঁটতে চান। হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিচারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অন্তরায় রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সম্প্রতি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) বলেন, ‘হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিচারে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে বেশকিছু অন্তরায় রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভূ-প্রকৃতিগত বিষয়। কারণ থানা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অপরাধ সংঘটিত হলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পাওয়া যায় না। অনেক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে সাক্ষী দিতে গেলে তিন দিন সময় লাগে। সেটি তারা করতে চান না। এ ছাড়া ভাষাগত সমস্যা প্রকট। কারণ তাদের ভাষা বোঝা যায় না। এ ছাড়া শিক্ষা এবং ভয়-ভীতি বিষয় তো থাকেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি যৌথভাবে অপারেশন পরিচালনা করে থাকে। আমরা চাঁদাবাজির খবর পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করি। যার কারণে তারা প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজির কৌশল পাল্টাচ্ছে। এখন তারা প্রকাশ্যের পরিবর্তে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকেছে। এ ক্ষেত্রে ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চালাই আমরা।’
বর্তমানে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরানোর দিল্লির ঢাকামুখী ষড়যন্ত্রের তীরের তীব্রতা কমে গেছে। দিল্লি বুঝে গেছে, হাসিনাকে আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফেরানো সম্ভব নয়; এ জন্য তারা ভিন্ন পথ ধরেছে। কিন্তু ঢাকার মতিঝিলে হঠাৎ করে ‘পাহাড়ি ছাত্র-জনতা’ নামক সংগঠন ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিলে পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাও করতে এলে সংঘর্ষ ঘটে। তারা পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দ দেখতে চায়।
পাহাড়িদের ঠেকাতে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামক সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাঠে নামলে দুই পক্ষের সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হয়। আবার গতকাল পাহাড়ি ছাত্র-জনতার ব্যানারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে এলে হাইকোর্ট মোড়ে শিক্ষাভবনের সামনে বাধা দেয় পুলিশ। প্রশ্ন হচ্ছে- এরা কারা? বাংলাদেশের সংবিধানে তো আদিবাসী নামে কোনো শব্দ নেই। পাহাড়ে যারা বসবাস করেন তারা নৃ-গোষ্ঠী। এদের (পাহাড়ি) রাস্তায় নামিয়ে পর্দার আড়াল থেকে কারা কলকাঠি নাড়ছে? আগের দিন মতিঝিলে পরের দিন হাইকোট এলাকায় পাহাড়ি ছাত্র-জনতার ব্যানারে রাজপথ গরমের চেষ্টা- নেপথ্যে কারা রয়েছেন। হঠাৎ করে কিছু পাহাড়ি ছাত্রের মিছিলে সংঘর্ষের ঘটনায় কিছু এনজিও ওই ছাত্র সংগঠনের পক্ষে অবস্থা নিয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করে বিবৃতি দিচ্ছে।