শিরোনাম
সোম. ডিসে ২৩, ২০২৪

“কাসাভা গিলে খাচ্ছে পাহাড়”

# নষ্ট হচ্ছে মাটির টপসয়েল # কমছে মাটির উর্বরতা # নিচে নামছে পানির স্তর #ন্যার্য মূল্য থেকে বঞ্চিত কৃষকরা # সর্বশান্ত হচ্ছে জমির মালিকরা #

নুরুল আলম:: কাসাভা গিলে খাচ্ছে পাহাড়। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিশেষ জাতের শস্য কাসাভা যা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত শিমুল আলু নামে। পার্বত্যাঞ্চলের বন ভূমিতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে এ কাসাভা চাষে বিরূপ প্রভাব পড়ছে পাহাড় ও পরিবেশে। এতে করে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার ভারসাম্য,কমছে মাটির উর্বরতা,নিচে নামছে পানির স্তর।

পাহাড়ে দরিদ্র কৃষকদের মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে পাহাড়ের উর্বর মাটি ও চাষাবাদের উপযোগি বনভূমি। যেখানে ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়ে আগুন দিয়ে পোঁড়ানো হচ্ছে নানা প্রাণ-প্রকৃতি ও উদ্ভীদে ভরা পাহাড়। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলার উপজেলা গুলোতে হাজার পর হাজার একর ভূমি এ কাসাভা চাষে প্রলোবনে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে স্থানীয় কৃষকরা।

চক্রটি চুক্তি-ভিত্তিক চাষাবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ২০০৫ সালে কাসাভা প্রকল্প শুরু করে। পাহাড়ে প্রায় দেড় দশক আগ থেকে স্বল্প পরিসরে এ চাষ শুরু হলেও বিগত ৭/৮ বছর ধরে পাহাড়ে বিস্তার লাভ করে কাসাভা চাষাবাদ। কারো কারো কাছে শিমুল আলু নামে পরিচিত এ কাসাভা চাষের সূত্র ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করে চলেছে প্রাণ এগ্রো বিজনেস লিমিটেড ও রহমান কেমিক্যাল লিমিটেড।

সূত্র বলছে, এই শিমুল আলু (কাসাভা) চাষের জন্য খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা,মহালছড়ি,গুইমারা,মানিকছড়ি উপজেলার বেশি বনভূমি উজাড় বৃদ্ধি করা হচ্ছে এর চাষ। যা মাটির টপ চয়েল উৎপাটন, ভূমি ধ্বস, মাটি ক্ষয় এর জন্য দায়ী।

এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা মিলতো হরিণ,বন মোরগ,খোরগোশ,গুইসাপ,বানর, লজ্জাবতী বানর,গন্ধগোকুল,বন বিড়াল সহ বিভিন্ন পাখি ও সাপের। ছিলো নিরাপদ আবাস্থলও। যা বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়।

আর পাহাড়ের উচু-নিচু বনভূমিতে কচি-কাঁচা গাছ কাটা থেকে শুরু করে বনভূমি ধ্বংসের কারনে এসব বন্যপ্রাণী হারিয়ে যেতে বসেছে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

আর এই লঙ্কাকান্ডের মুল হোতারা রাজি হয়না মিডিয়ার সামনে কথা বলতে। তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে কৌশলে পালিয়ে যায় তারা। শুধুমাত্র খাগড়াছড়িতেই এই দুটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে প্রায় ছয় হাজার ৬শ একর এর অধিক কাসাভা বাগান।

এসব কাসাভা চাষের বনভূমি জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রাধীন স্থানীয়দের বন্দোবস্তিকৃত এবং সরকারি খাস জমির সংমিশ্রণ আছে বলে জানান স্থানীয়রা। তবে এতোসব লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেলেও এদায়ভার কার তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন নাগরিকরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পুষ্টি উপাদানের জন্য ভিনদেশে জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় রয়েছে কাসাভা। বাংলাদেশে কাসাভার স্টার্চ পাউডার টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। চাহিদা মেটাতে কাসাভা চাষ করছে স্থানীয় কোম্পানিগুলো। বর্তমানে দেশে বছরে ৫০ হাজার টনেরও বেশি কাসাভা উৎপাদন হয়। যা চাহিদার মাত্র দুই শতাংশ।

বাণিজ্যিকভাবে কাসাভা চাষ করছে রহমান কেমিক্যাল লিমিটেড ও প্রাণ এগ্রো বিজনেস লিমিটেড। চুক্তি-ভিত্তিক চাষাবাদের মাধ্যমে ২০১৪ সালে কাসাভা প্রকল্প শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ১২ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হবিগঞ্জে একটি স্টার্চ এবং তরল গ্লুকোজ প্ল্যান্ট স্থাপন করে তারা।

সরেজমিন তথ্য অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, সবুজ পাহাড়ে সম্প্রসারিত দক্ষিণ আফ্রিকার ফসল কাসাভা চাষে মুল অর্থ যোগানদাতা প্রাণ আর এফ এল গ্রুপের প্রাণ এগ্রো বিসনেস লিমিটেড ও রহমান কেমিক্যালস লিমিটেড সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার প্রলোভনে আংশিক সহায়তাদানের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কাসাভা চাষে উৎসাহ জোগাচ্ছে গরিব লোকদের।

অন্যদিকে চুক্তির শিকলপড়ানো ঐ কোম্পানি দুটির কাছে তাদের নির্ধারিত দামেই কাসাভা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে চাষিরা। ফলে ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে ঘাম ঝড়ানো কৃষকরা। এতে উর্বরতা হারাচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর পাহাড়ের মাটি,বাড়ছে মাটির ক্ষয় এবং ঘটছে পাহাড় ধসের ঘটনা।

অনুসন্ধানে জানা আরো যায়, কাসাভা চাষে দুটি কোম্পানি চাষিদের একর প্রতি ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয়। চাষিদের একরপ্রতি খরচ হয় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। একজন মহিলা শ্রমিকের দৈনিক মুজুরি ৩৫০টাকা এবং পুরুষের মুজুরি ৬০০ টাকা।

উৎপাদিত কাসাভা চুক্তি মোতাবেক তাদের নির্ধারিত মূল্যে কেজি প্রতি ১০টাকা হারে চাষিদের নিজ দায়িত্বে সিলেট হবিগঞ্জ (সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কারখানায়) পৌঁচে দিতে হয়। গত বছর ৯টাকা ৫০ পয়সা হারে দেয়া হয়েছে কৃষকদের। এই কাসাভা গ্লুকোজ, বার্লি, সুজি, চিপসসহ বেকারি সামগ্রি এবং ঔষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

জেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী,এ বছর জেলায় ১০১১ হেক্টর জমিতে কাসাভা চাষ করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে সবচেয়ে বেশি কাসাভা চাষ করা হয়েছে মাটিরাঙ্গায় ৩৫০হেক্টর ও মানিকছড়িতে ৪৫২ হেক্টর। বাস্তবে কাসাভা চাষের পরিমান আরো বেশি বলে সূত্র জানায়।

পাহাড়ের আবহাওয়া অনুকুলে ও খরচ কম হওয়ায় কাসাভা চাষ দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। গাছের ছোট ছোট টুকরো করে রোপণ করা হয় এবং ১২ মাস পর মাটি খুঁড়ে আলু তোলা হয়। মাটি উপড়ে আলু তোলার
ফলে পাহাড়ে গাছ পালা নাথাকায় বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির স্রোতে পাহাড়ে প্রচুর ক্ষয় এবং পাহাড় ধসের সৃষ্টি হয়। পাহাড়ে কাসাভা চাষে কোম্পানী গুলো লাভবান হলেও প্রান্তিক কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেনা।

কাসাভা চাষী মাহবুবুর রহমান শরীফ জানান, কোম্পানির লোকজনদের কথায় উৎসাহিত হয়ে তিনি তার নিজস্ব ১০ একর এবং লিজ নিয়ে আরো ৫ একর মোট ১৫ একর টিলা ভূমিতে কাসাভার চাষ করেছেন। এতে একর প্রতি ১৫-২০ হাজার টাকা করে অগ্রীম দেয়া হয়েছে। এযাবৎ একর প্রতি খরচ হয়েছে ৫০-৫৫ হাজার টাকা।

উৎপাদিত আলুর/কাসাভার ন্যায্য দেয়া হচ্ছে না উল্লেখ করে শরিফ আরো বলেন, দেশে ৫০ থেকে ৬০ টাকার নিচে কোন আলু জাতীয় পন্যের দাম নাই। অথচ নাম মাত্র অগ্রীম টাকা দিয়ে চুক্তির শিকলে বন্ধি করে সিলেট হবিগঞ্জ কোম্পানীর কার খানায় কেজি প্রতি মাত্র ১০ টাকায় পৌঁচে দিতে হচ্ছে। আলু উঠানোর পর লাভ ক্ষতি হিসাব করে আগামীতে কাসাভা চাষ করবেন বলে জানান তিনি।

প্রাণ এগ্রো বিসনেস লিমিটেডদর ম্যানেজার রেজাউল করিম কাসাভা সংক্রান্ত তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন,মিডিয়ার সাথে কথা বলা নিষেধ রয়েছে। তথ্যের প্রয়োজনে ঢাকায় মিডিয়া সেলের সাথে যোগযোগ করতে পারেন। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো দুই কৃষক কাসাভার আন্ত-প্রাপ্ত তুলে ধরে পাহাড়ে কাসাভার বিস্তার,লাভ-ক্ষতি থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে মতামত তুলে ধরেন।

পিঠাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ আহমেদ রাসেল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাসাভা চাষের দ্রুত বিস্তার উদ্বেগজনক। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বনাঞ্চল পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে। এ চাষাবাদ আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র ও বন্য প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকারক এবং জলবায়ু সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

তিনি আরো বলেন, বর্ষা মৌসুমে ভূমিক্ষয় হয়, যা পাহাড়ে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ায়। বন ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার সময় কৃষকরা কখনো কখনো আগাছানাশক ওষুধ ব্যবহার করে ঝোপঝাড় উজাড় করে। যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্যও মারাত্বক হুমকি।

খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ বাছিরুল আলম পাহাড়ে কাসাভা চাষে কৃষকদের কৃষি সম্প্রসারণ কোন দিক নির্দেশনা দেয়নি উল্লেখ করে বলেন, কিছু প্রাইভেট কোম্পানী তাদের লাভের জন্য কাসাভা চাষ খাগড়াছড়িতে নিয়ে এসেছে। কাসাবা পাহাড়ের জন্য উপযোগি হতে পারেনা মন্তব্য করে তিনি কাসাভা চাষের মাটির ক্ষয়সহ খারাপ দিক তুলে ধরে সরকারি সিধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। একই সাথে পাহাড়ে চাষাবাদের ক্ষেত্রে নানা ফল,বৃক্ষের কথা তুলে ধরে কাসাভার পাহাড়ে ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে লেখনির মাধ্যমে জনসচেতনতা প্রয়োজন বলে মনে করেন।

খাগড়াছড়ি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: ফরিদ মিঞা কাসাভা চাষের জন্য কৃষি বিভাগের পৃষ্টপোশকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তার লাভ করছে বলে অভিযোগ এনে বলেন, এসব নব ভূমি জেলা প্রশাসককৃত বন্দোবস্তিকৃত ব্যাক্তিমালিকানাধীন জায়গার এ চাষ হচ্ছে। ব্যাপক এলাকা জুড়ে এ কাসাভার চাষের কারনে শত শত এক জায়গা খালি হচ্ছে প্রতিনিয়তই।

বনে আগুন দেয়ার কারনে জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে পাহাড় বনায়নের জন্য উপযোগি বলে উল্লেখ করে প্রকৃতি রক্ষায় বনায়নের বিকল্প নেই মন্তব্য করেন। কাসাভা চাষ পাহাড়ের জন্য উপযুক্ত কিনা তা বাংলাদেশের উপযোগি কিনা, এ চাষে এদেশের বায়ু কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা সে সিধান্ত নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নজর দেয়ার আহ্বান জানান। এ সময় তিনি পরিবেশ রক্ষায় বনায়নসহ করণীয় বিষয় তুলে ধরেন তিনি।

এদিকে কাসাভা চাষের বিষয়টি দৃষ্টি গোছর হয়েছে জানিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান বলেন, জেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সভায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। পাহাড়ে কাসাভা চাষ, প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব খতিয়ে দেখার জন্য উপজেলা বনও পরিবেশ কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ চাষে খারাপ প্রভাব,অনুমোদন,ভাল দিক-খারাপ দিক তদন্ত করে জানালে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান জেলা প্রশাসক।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!