নুরুল আলম:: পার্বত্যঞ্চলের গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালিরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। ১৯৮৬-৮৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তৎকালীন এরশাদ সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে পুনর্বাসিত ২৬ হাজার ২শ’ ২০ বাঙালি পরিবারকে ৮১টি গুচ্ছগ্রামে আনা হয়। শুরু হয় পরিবার প্রতি রেশনের ব্যবস্থা। কথা ছিল স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরে এলে এ রেশন ব্যবস্থা পরবর্তী তিন বছর চালু থাকবে। কিন্তু এসব পরিবার আর নিজ বসতভিটায় ফিরে যেতে না পারায় গত দুই যুগের অধিক সময় ধরে পরিবার পিছু ৮১ কেজি করে রেশন প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
অপরদিকে ১৯৯৮ সালে ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ১শ’ ৭০ পরিবার পাহাড়ি ও অস্ত্র সমর্পণকারী শান্তিবাহিনীর ১ হাজার ৯শ’ ৪৫টি পরিবারের পরবর্তী এক বছরের জন্য রেশন দেয়ার কথা থাকলেও দেড় যুগের অধিক সময় ধরে প্রতি জন প্রাপ্তবয়স্ক ২১ দশমিক ৭০ কেজি হারে ও অপ্রাপ্তবয়স্করা মাথাপিছু ১০ দশমিক ৮৫ কেজি হারে এবং অস্ত্র জমাদানকারী শান্তিবাহিনীর ১ হাজার ৯শ’ ৪৫ পরিবার কার্ডপ্রতি ১শ’ কেজি হারে রেশন পেয়ে আসছে।
সূত্র মতে, গুচ্ছগ্রামের বাঙালি পরিবার, ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী ও অস্ত্র সমর্পণকারী শান্তিবাহিনীর পরিবারের পিছনে সরকারকে প্রতিমাসে খাদ্যশস্য বরাদ্দ দিতে হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার ৭শ’ ১২ মেট্রিক টন। সে হিসেবে প্রতিবছর বরাদ্দ দিতে হয় প্রায় ৪৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। সম্পূর্ণ অনুৎপাদন খাতে বরাদ্দ দেয়া এসব খাদ্যশস্য যার বাজার মূল্য শত কোটি টাকার উপরে।
অভিযোগ রয়েছে, এ ধরনের রেশন ব্যবস্থার কারণে সরকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলেও লাভবান হচ্ছে গুচ্ছগ্রাম কেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেট। গুচ্ছগ্রামের বসবাসকারী ৯০ ভাগ পরিবারের রেশন কার্ড সিন্ডিকেটের হাতে। যাদের হাতে কার্ড রয়েছে তাদের মাঝে রেশন বিতরণ নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ।
অভিযোগ রয়েছে, গুচ্ছগ্রামের জন্য বরাদ্দ খাদ্যশস্যের ৮০/৯০ ভাগই খাগড়াছড়ি আসে না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৌশলে খাদ্যশস্য থেকে যায় চট্টগ্রামে। অথচ খাদ্যশস্য খাগড়াছড়ি আনার ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা পরিবহন খরচ লোপাট হচ্ছে।
এদিকে গুচ্ছগ্রামে প্রকল্প চেয়ারম্যান নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। গুচ্ছগ্রাম ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী স্থানীয় জনপ্রনিধিদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকল্প চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সে সরকার দলীয়ভাবে গুচ্ছগ্রামে প্রকল্প চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে আসছে। প্রতি দুই বছর পর পর নতুন করে প্রকল্প চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়।
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে লোভনীয় এই পদে মনোনয়ন পেতে দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন একটি মহল। এমনকি একটি প্রকল্প চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ২/৩ জনের কাছ থেকে টাকা নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিটি প্রকল্প চেয়ারম্যান নিয়োগে ৩/৪ লক্ষ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। যিনি টাকার পরিমাণ বেশি দিচ্ছেন তাকেই চূড়ান্তভাবে প্রকল্প চেয়ারম্যান মনোনয়ন দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি একাধিক কর্মকর্তা জানান, পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলায় ৮১টি গুচ্ছগ্রামের ২৬ সহস্রাধিক পরিবারের মধ্যে অধিকাংশ পরিবারই এখন আর রেশননির্ভর নয়। তেমনিভাবে ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী ও শান্তিবাহিনীর অনেক সদস্যের বলতে গেলে এখন তেমন কোন সমস্যা নেই।
স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন, এ ধরনের রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে কোন প্রকার সুফল তো আসছেই না, বরং সরকারের আর্থিক গচ্ছার পাশাপািশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
পাশাপাশি রেশননির্ভর পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোন পরিকল্পনা না থাকায় তারা এখন কর্মহীন অলস জীবনযাপন করছে। অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটে ভুগছে তারা।
অন্যদিকে গুচ্ছগ্রামে বন্দী বাঙালিদের দাবি, ‘আমরা আর বন্দি জীবন চাই না। আমাদের নিজ বসতভিটা ফিরিয়ে দিন। সেখানেই চাষাবাদ করে জীবন ধারণ করবো।’
গুচ্ছগ্রামবাসীদের দাবি, তাদের জায়গা জমি একশ্রেনীর উপজাতীরা দখল করে নিয়ে যাচ্ছে। বাঙালিদের পূর্ণবাসন করা হলে বেদখলীয় জায়গাগুলো উদ্ধার করে চাষাবাদ ও বাগানবাগিচা করে তারা ছেলে সন্তান নিয়ে সুখে বসবাস করতে পারতো।
ইতোমধ্যে গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের তাদের নিজ নিজ বসতভিটায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি নির্দেশনা জারী করলেও তা বাস্তাবায়ন হয়নি। তাই স্থানীয়দের প্রশ্ন, স্থায়ী পুনর্বাসন না করে কতদিন এভাবে বছরের পর বছর সরকার ভর্তুকি দিয়ে রেশন দিয়ে যাবে?