ঢাকা: ৩০ এপ্রিল, মঙ্গলবার ২০২৪:
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রানহানী, যানজট-জনজটে নাকাল দেশবাসীকে যাতায়াতে ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর যাবত ধারাবাহিকভাবে রেলখাতের উন্নয়নে লাখো কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে নতুন নতুন রেলপথ ও রেল ষ্টেশন নির্মান, নতুন কোচ ও ইঞ্জিন আমদানী করে এই খাতকে সম্মৃদ্ধ করার মাধ্যমে রেলসেবা জনগনকে দোরগোড়ায় পৌছে দিতে চাইছে। ঠিক তখনই রেল কর্তৃপক্ষ রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহারের নামে ভাড়া বৃদ্ধি করে দুরপাল্লার যাত্রাপথে রেলের ভাড়া বাসের ভাড়ার চেয়ে বেশী নির্ধারন করে বাস মালিকদের বিশেষ সুবিধা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এহেন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে রেলপথকে অতীতের মতো নিরাপদ ও সাশ্রয়ী রাখার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
আজ ৩০ এপ্রিল সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহারে বাসের চেয়ে রেলের ভাড়া বেশী, “এহেন ভাড়া বৃদ্ধির গণবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে” আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
রেলের রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি যাত্রী কল্যাণ সমিতি পর্যবেক্ষন করে নিম্নে ৫টি রুটের বাস এবং রেলের ভাড়া ও সময়ে তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে। এতে দেখা গেছে,
১। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম তূর্না নিশিতা ট্রেনে শোভন চেয়ার আগের ভাড়া ছিল ৩৪৫ টাকা এখন রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহারের পর ৪০৫ টাকা। এই টিকিট কালোবাজারীর কাছ থেকে যাত্রীদের কিনতে হয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে লোকাল বাসের ভাড়া ৪০০ টাকা, ডাইরেক্ট বাসের ভাড়া ৬৮০ টাকা। ঢাকা – চট্টগ্রাম তূর্না নিশিতা ট্রেনে এসি চেয়ারে আগের ভাড়া ছিল ৬৫৬ টাকা রেয়াত প্রত্যাহারের পরে এখন ৭৭৭ টাকা। এই টিকিট কালোবাজারীর কাছ থেকে কিনতে হয় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায়। অথচ এই রুটে এসি বাসের ভাড়া ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বাসে যেতে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা, ট্রেনে সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা।
২। ঢাকা – খুলনা রুটে ট্রেনের শোভন চেয়ারে ৫০০ টাকার ভাড়া এখন ৬২৫ টাকা। অথচ এই রুটে বাসে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায় যাতায়াত করেন যাত্রীরা। এই রুটে ট্রেনে এসি চেয়ার ৯৫৫ টাকার টিকিট এখন ১১৯৬ টাকা যা কালোবাজারীর কাছ থেকে ১৫০০ টাকায় কিনতে হয়। অথচ ঢাকা-খুলনা রুটে বিলাস বহুল এসি বাসের ভাড়া মাত্র ৯০০ টাকা।
৩। ঢাকা-রংপুর রুটে ট্রেনের শোভন চেয়ার ৫০৫ টাকা টিকিট এখন ৬৩৫ টাকা যা কালোবাজারীর কাছ থেকে কিনতে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা লাগে। ঢাকা – রংপুর রুটে লোকাল বাসের ভাড়া ৪০০/৫০০ টাকা, ডাইরেক্ট বাসের ভাড়া ৮০০ টাকা। এই রুটে ট্রেনের এসি চেয়ার ৯৬৬ টাকার টিকিট এখন ১২১৪ টাকা যা কালোবাজারীর কাছ থেকে কিনতে লাগে ১৫০০ টাকায়। এই রুটে বিলাশ বহুল বাসের এসি টিকিট ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায় পাওয়া যায়। ঢাকা – রংপুর ট্রেনের এসি বার্থ ২১৮০ টাকা যা কালোবাজারে কিনতে ৩০০০ টাকা লাগে অথচ বিলাস বহুল বাসে এই রুটে এসি স্লিপার ১৬০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এই রুটে বাসে যেতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা, ট্রেনে সময় লাগে ১০ থেকে ১১ ঘন্টা।
৪। ঢাকা-কুড়িগ্রাম রুটে ট্রেনের ৫১০ টাকার শোভন চেয়ার টিকিট এখন ৬৪৫ টাকা যা কালোবাজারে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় কিনতে হয়। অথচ এই রুটে ৬০০ থেকে ৯০০ টাকায় উন্নতমানের বাসে যাওয়া যায়। এই রুটে ট্রেনের এসি চেয়ার ৯৭২ টাকার টিকিট এখন ১২৩৭ টাকা যা কালোবাজারীর কাছ থেকে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকায় কিনতে হয়। অথচ বিলাস বহুল এসি বাসের টিকিট ১২০০ টাকায় পাওয়া যায়।
৫। ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে এসি বার্থ এর মূল্য ২৪০০ টাকা। এই রুটে বিলাস বহুল বাসে এসি স্লিপারের ভাড়া ১৮০০ টাকা।
পর্যবেক্ষনে আরো দেখা গেছে- রেলখাত লাভজনক করার ঘোষনা দিয়ে ২০১২ সালে সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১১০ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৭ শতাংশ রেলের ভাড়া বাড়িয়েছিলেন। একই সাথে ২০১২ সালের ভাড়া বৃদ্ধির সময় ট্রেনের ওই সময়ে বিদ্যামান “সেকশনাল রেয়াতি সুবিধা” প্রত্যাহারের পরে আসলেই কি রেল লাভবান হয়েছিল? ঐ বছর অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অথ বছরে রেলের লোকসান ছিল ১২২৬ কোটি টাকা। এতে বুঝা যায় কেবলমাত্র ভাড়া বৃদ্ধি করে লাভবান হওয়া বা লোকসান কমানো কোনভাবেই সম্ভব নয়। বর্তমানে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে যে হারে রেলের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, এতে যাত্রীরা রেল বিমুখ হবে, রেলে টিকিট বিহীন যাত্রী যাতায়াতের সংখ্যা বাড়বে, রাজস্ব আয় কমবে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লুটপাটের সুযোগ আরো বাড়বে। রেলের আয়বর্ধক খাত যেমন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে পন্যবাহী ট্রেন থেকে আয় বাড়ানো দিকে না ঝুকে রেলওয়ে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নিয়ে আয় বাড়ানোর যে আকাশকুসুম পরিকল্পনা করছে সেটি কাযত ব্যর্থ বলে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার রেলকে বিকশিত করার লক্ষ্যে গত ১৪ বছরে ৯৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরে এখনো ৬০ শতাংশ রেলপথ ঝুকিপূর্ন, ৮০ শতাংশ লোকোমোটিভ ও ৬৩ শতাংশ কোচ মেয়াদোত্তীর্ন যা অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল শেষ হয়ে গেছে। পরিকল্পনার গলদে ট্রেনের টিকিট ১০দিন আগে কিনতে হচ্ছে যাত্রীদের, অথচ ৯০ শতাংশ যাত্রী ১০দিন আগে ভ্রমন পরিকল্পনা করতে পারে না, অন্যদিকে বাসের টিকিট তাৎক্ষনিক পাওয়া যাচ্ছে। ট্রেনের টিকিট যাত্রীরা সহজে কাটতে পারেনা, ফলে কখনো কালোবাজারী বা স্টেশনের পার্শবর্তী কম্পিউটারের দোকান থেকে টিকিট কিনতে হয়। এভাবে টিকিট ক্রয়ে কারনে সাধারণ ও নি¤œ আয়ের মানুষ অনেক সময় প্রতারিত হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে কখনো কখনো রেলে কর্তব্যরতদের ম্যানেজ করে বিনা টিকিটে ভ্রমনে বাধ্য হন অনেক যাত্রী। ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটলে মাঝপথে যাত্রীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে, এমন পরিস্থিতিতে রেল লাইনের আশে পাশে দোকান থাকেনা বলেই অনেকে অনাহারে অধাহারে কষ্ট ভোগ করতে হয়। লাইনচ্যুতি ও শিডিউল বিপর্যয়ের কারনে অনেক যাত্রীর চাকুরী, পরীক্ষা, বিদেশের ফ্লাইট, আদালতের হাজিরার মতো জনগুরুত্বপূর্ন কাজে যোগ দিতে না পেরে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতে সাধারন মানুষকে রেলমুখি করে নামমাত্র মূল্যে টিকিট বিক্রি করে রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছে। ভারতে শেয়ালদহ রেল ষ্টেশন থেকে আজমীর জংশন পযন্ত ১৬৪২ কিলোমিটার দুরত্বে ১টি প্রথম শ্রেনীর বার্থ সীটের ভাড়া মাত্র ৬৯০ রুপি, সেখানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ৩৪৬ কিলোমিটার (প্রকৃত দুরত্ব ৩০০ কিলোমিটারেরও কম) ১টি নন এসি বার্থ সীটের ভাড়া ৮১০ টাকা। শেয়ালদহ রেল ষ্টেশন থেকে বনগাঁও ৭৭ কিলোমিটার দুরত্বে লোকাল ট্রেনের ভাড়া মাত্র ২০ রুপি। আর বাংলাদেশে ১টি টিকিট কাটতে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডট কমকে কমিশনকে কমিশন দিতে হয় ২০ টাকা। সহজ ডটকমসহ বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন খাতে পণ্য ক্রয় বা ব্যবসায়িক কৌশলের কারনে গ্রাহককে নানামুখী ছাড় দিলেও রেলের ক্ষেত্রে উল্টো আচরণ করছে। অর্থাৎ রেল প্রশাসনের মতোই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও যাত্রীদের চাহিদার সুযোগ নিয়ে শুধুই বেহিসাবী মুনাফা করে যাচ্ছে। ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে রেলে সাশ্রয়ী মূল্যে পন্য পরিবহন করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের পন্যবাহী ট্রেনে ৫০ থেকে ৭৫ টি পর্যন্ত বগি ব্যবহার করে খরচ কমিয়ে আনে। এমন পদ্ধতিতে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে সারাদেশে রেলপথে পন্য পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি একজেলা থেকে অন্যজেলায় মাছ, মাংস, সবজী ও নিত্যপন্য পরিবহন করা গেলে এদেশেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব। অন্যদিকে রেলের অনিয়ম-দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা বন্ধ করে, সম্পদের সুষ্টু ব্যবহার, বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করে বানিজ্যিকভাবে ব্যবহারের পাশাপাশি নানামুখী লাভজনক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে রেলকে ধীরে ধীরে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করা সম্ভব। এজন্য রেল মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়েতে সৎ, নিবেদিতপ্রান, চৌকষ, ব্যাপক দেশি-বিদেশি কারিগরি জ্ঞান সম্মৃদ্ধ একঝাঁক দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা প্রয়োজন। একই সাথে শেখ হাসিনার ভিষণ বাস্তবায়নে রেলের উপর ঝেঁকে বসা দুনীতিবাজ কালোবিড়ালের বিষদাত উপরে ফেলা এখন সময়ের দাবী।
এতে আরো উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ন মহাসচিব মনিরুল হক প্রমুখ।