শিরোনাম
মঙ্গল. ডিসে ২৪, ২০২৪

যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বর্ণিল জীবনাচার, ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি পার্বত্য অঞ্চলের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিন জেলাকে বিশেষভাবে করেছে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ অঞ্চলকে নিয়ে বারবার বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় শান্তির পরিবর্তে সংঘাতকে উস্কে দিয়েছিল। এই সংঘাতময় পরিস্থিতি নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী, সুদক্ষ ও প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্বে কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির পক্ষ্যে তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)-এর সাথে কয়েক দফা সংলাপের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে পার্বত্য জেলাসমূহে বিরাজমান দীর্ঘ সংঘাতের অবসান হয় এবং অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিবেশের অবতারণা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আন্তরিকতার কারণেই অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সেখানকার বিভিন্ন ভাষাভাষী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সকলের জীবনে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভিযাত্রায় পাহাড়ি জনপদে বর্তমানে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলশ্রুতিতে ১৫ জুলাই ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। সেই থেকেই গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। মাননীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ মহোদয়কে আহ্বায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদা) করে ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি তিন সদস্য বিশিষ্ট চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুর্নগঠন করা হয়। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কমিটি ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে। গঠন করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এছাড়া গঠন করা হয় ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স। পার্বত্য চট্টগ্রামকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে ইতোপূর্বে গঠন করা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইতোমধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৪টি ধারার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং বাকি ধারাগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বাকি ধারাগুলোরও বাস্তবায়ন চলমান।

পার্বত্য চট্টগ্রাম তার অনন্য সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই অঞ্চলের সম্ভাবনা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগণের জীবনকে উন্নত করার প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনকেন্দ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁর বলিষ্ঠ নের্তৃত্ব এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম ভিত্তি হল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। রাস্তা, সেতু এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক সংযোগ প্রকল্পগুলি কেবলমাত্র পরিবহনের সুবিধাই দেয়নি বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও সংযুক্ত করেছে এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে ব্যবধান কমিয়েছে।

অবকাঠামোর উন্নতি শুধুমাত্র পার্বত্যবাসীদের জীবনকে সহজ করেনি বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা ভেসে সরীসৃপের মতো নির্মিত হয়েছে শত শত কিলোমিটারের ঝিগঝাগ পিচঢালা মসৃণ পাহাড়ি সড়ক। সড়কের পাশাপাশি বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট এক পাহাড়কে আরেক পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে। যারা বান্দরবানের থানচি ভ্রমণ করেছেন তারা এর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। থানচিতে যেখানে যাওয়া আসায় দুই-তিন দিনের পথ ছিলো, এখন সে পথ মাত্র দু-তিন ঘন্টার ব্যবধানে দাঁড়িয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির দলিল স্বাক্ষরের কারণে।

পাহাড়ি জনপদের কাছে তা এখন স্বপ্নের মতো। যাত্রীবাহী চাঁদের গাড়ি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, মাইক্রোবাস, জিপ অনায়াসেই চলাচল করছে এসব সড়কগুলোতে। পার্বত্য দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। আর এর সুফল ভোগ করছেন স্থানীয় জনগণ। সরকারের ২০০৯-২০২৩ শাসনামলে অসংখ্য স্কুল, কলেজ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যা এ অঞ্চলের অনগ্রসর জনগোষ্ঠিকে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান এবং জ্ঞান দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করেছে। পার্বত্যাঞ্চলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অবদানের কারণেই পার্বত্যবাসীরা পার্বত্যাঞ্চলের বিশাল উন্নয়নের সমঅংশীদার হতে পেরেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪শত ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ১শত ৬১টি স্কিম প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বিগত ২৬ বছরে পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় নানামুখী অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পর আওতায় নারী উন্নয়ন, আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। ৪ হাজার ৮ শত পাড়াকেন্দ্রে শিশু ও তাদের পরিবারের নিকট মৌলিক সামাজিক সেবাগুলো পৌঁছে দিতে পাড়াকেন্দ্র নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীরা আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতায় এখন সরকারের সকল সেবা ভোগ করতে পারছে। যা গত এক যুগ আগেও সম্ভব ছিল না। ১ লাখ ২০ হাজার শিশুকে প্রাক শৈশব স্তরের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ২ লাখ ৬ হাজার পাহাড়ি পরিবারের শিশু, কিশোরী ও মহিলাদের রক্ত স্বল্পতা ও পুষ্টি ঘাটতিজনিত সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে সরকারের সেবা প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। চারটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ১ হাজার ২শ শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রবাহের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধক কর্মসূচি হিসেবে উন্নত জাতের বাঁশ উৎপাদন, অস্বচ্ছল ও প্রান্তিক পরিবারের নারী উন্নয়নে গাভী পালন প্রকল্প, সুগারক্রপ চাষাবাদ জোরদারকরণ প্রকল্প, কফি ও কাজু বাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প, তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকদের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প, প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ, মিশ্র ফল চাষ, উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সরকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের জন্য এক অপার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ১ হাজার ২ শত ১২ কিলোমিটার পাকাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ৭শত কিলোমিটার কাঁচা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে-যা পরবর্তীতে পাকাকরণের মাধ্যমে জনগণের যাতায়াতের দুর্গম পথকে সুগম করে দিতে বদ্ধপরিকর রয়েছে এ সরকার।

৬শত ১৪ কিলোমিটার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। পার্বত্য তিন জেলায় ৯ হাজার ৮ শত ৩৯ মিটার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র রাঙ্গামাটি জেলাতেই নির্মাণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৯ শত ২৮ মিটার ব্রিজ। একইসাথে কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে ১ শত ৪১ মিটার। ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক দুর্গম পাহাড়ি জনপদ্রের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপকে বাস্তবায়ন করেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার।

পার্বত্য চুক্তির আগের পার্বত্যাঞ্চল ও চুক্তি উত্তর পার্বত্যাঞ্চলের চিত্র সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে তুলো ধরা হলো:
পার্বত্য চুক্তির আগে পার্বত্য তিন জেলায় উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১ শত ৯৬টি। চুক্তির ২৬ বছরে সেখানে উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৪টিতে। কলেজ ছিল যেখানে ২৫টি, সেখানে এখন কলেজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১টি। পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিন পার্বত্য জেলায় নতুনভাবে গড়ে ওঠেছে তিনটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। রাঙ্গমাটিতে একটি মেডিক্যাল কলেজ এবং বান্দরবান জেলায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপের (পিপিপি) মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়। পার্বত্য তিন জেলায় চুক্তির আগে স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র ৯১টি। চুক্তির পর স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২১২-তে উন্নীত করা হয়। ছোট-মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র ১৭টি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর মাঝারি-বড় ৪৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ক্ষুদ্র-কুটির শিল্পের সংখ্যা যেখানে ছিল ২ হাজার ২৬৬টি মাত্র, চুক্তির পর সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২৯৯টি। এছাড়া মসজিদ, মন্দির, কিয়াং, গীর্জা সমহারে স্থাপনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক এ সরকার সকল ধর্মের প্রতি সমান আন্তরিকতার পরিচয় রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, শিশু পার্ক, বিনোদন পার্ক, বাস টার্মিনাল, ঈদগাহ্, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, বাঁধ, স্টেডিয়াম, ফুড বেকারি, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটনকেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপনের মাধ্যমে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে দিয়েছে সরকার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে শান্তিচুক্তির পটভূমিতে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, পর্যটন ইত্যাদি সকল দিক থেকে পার্বত্য অঞ্চল এখন আরো বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়েছে বলে দাবি রাখে।

তথ্য সূত্র: (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পাদিত ১৫ বছরের উন্নয়ন সংক্রান্ত পুস্তিকা ও বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে সংগৃহীত)।

লেখক: তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!