নুরুল আলম:: খাগড়াছড়িতে অবৈধ ভাবে ইট তৈরির কাজ শুর। জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ৩৫টি ইটভাটার ইট তৈরি ও ফসলী জমি থেকে স্কাভাটার দিয়ে ট্রাকে মাটি সংগ্রহ ও সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই বনের মাঝে, লোকালয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়কারী এসব ভাটা। ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে পাহাড় ও কৃষি জমির উর্বর মাটি। বন, পাহাড় ও জমির উর্বর মাটি উজাড়ের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলায় সর্বাধিক ৯টি ইটভাটা রয়েছে। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় কোনও ভাটা না থাকলে সীমান্তবর্তী চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার একাধিক ইটভাটা থাকার প্রভাব পড়ছে সেখানকার পরিবেশ ও স্থানীয় জনজীবনে। এছাড়া জেলার সদর উপজেলায় ৫টি, দিঘীনালায় ২টি, পানছড়িতে ৩টি, গুইমারায় ৫টি, মানিকছড়িতে ২টি, মাটিরাঙ্গায় ৬টি, মহালছড়িতে ৩টি ও রামগড়ে ৯টিসহ মোট ৩৫টি ইটভাটা রয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশ ইটভাটায় ইট তৈরির ও পোড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। তারা সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধ ভাবে বনের কাঠ কেটে ব্রিকফিল্ডে মজুদ করছে। এছাড়াও ফসলী জমি থেকে মাটি কেটে ব্রিকফিল্ডে ইট তৈরির কাজে ব্যবহার করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গুইমারায় ৫টি ইটভাটার মধ্যে ৪টিতে অবৈধ ভাবে জ্বালানী কাঠ ব্যবহারের জন্য ২লক্ষ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট রাজিব চৌধুরী। এছাড়াও মাটিরাঙ্গা উপজেলা তবলছড়িতেও ১টি ইটভাটায় ১লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, প্রতি বছর জেলায় অক্টোবর মাসে ইটভাটাগুলোর কাজ শুরু হয় এবং তা চলে মে-জুন পর্যন্ত। বৃষ্টির আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ইটভাটায় ১২-১৩ রাউন্ড ইট পোড়ানো হয়। প্রত্যেক রাউন্ডে ৭/৮ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রত্যেক ইটভাটায় বছরে গড়ে এক কোটি ইট উৎপাদন হয়। খাগড়াছড়ির সব ভাটায় বছরে প্রায় ৪৩ কোটি ইট তৈরি হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ২১৫ থেকে ২২০ কোটি টাকা (প্রতি হাজার গড়ে ৫/৬ হাজার টাকা ধরে)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি রাউন্ড ইট পোড়াতে প্রায় ৮-৯ হাজার মণ (১ মণে ৪০ সের) জ্বালানি কাঠ লাগে এবং এক মৌসুমে একটি ইটভাটায় গড়ে কাঠ পোড়ে প্রায় এক লাখ মণ। সেই হিসেবে ৩৫ইটভাটায় বছরে কমপক্ষে ৩৫ লাখ মণ কাঠ পুড়ানো হয়। ইটভাটা এবং ভাটা শ্রমিকের রান্নাবান্নার কাজেসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকার গাছ পুড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, ইটভাটাগুলোতে এসব জ্বালানি কাঠ যাচ্ছে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বন থেকে। ইটভাটায় গাছের ছোট ছোট ডালপালা বা পাতা ব্যবহার হয় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোটা মোটা গাছ করাত দিয়ে কেটে ছোট ছোট টুকরা করে ইটভাটার চুল্লিতে পোড়ানো হয়।
পরিবেশ কর্মীদের অভিযোগ, এসব কাঠ সরবরাহে কয়েক কোটি গাছ কাটা হয়। আর এভাবে ইটভাটা চলমান থাকলে আগামী কয়েক বছরে খাগড়াছড়িতে বন বলতে কিছু থাকবে না বলে আশঙ্কা তাদের। বন না থাকলে বন্যপ্রাণী, পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গ হুমকিতে পড়বে, নষ্ট হবে পরিবেশের ভারসাম্য।
সচেতন মহল বলেন, জেলার প্রায় ৩৫ ইট ভাটায় গড়ে ৫০ কোটি টাকার জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, কাঠ সরবরাহকারীরা প্রত্যেকে বছরে প্রতি মণ গাছ ৯০ থেকে ১০০ টাকা হারে ইটভাটায় সরবরাহ করেন। একটি ইটভাটায় বছরে ৯০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা বা তারও বেশি টাকার কাঠ সরবরাহ করতে হয়। এসব কাঠ স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে কেনেন বলে জানান তারা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, গাছ সরকারি বনের, না বনাঞ্চলের না ব্যক্তি মালিকানার সেটা দেখার বিষয় নয়। কোনও গাছ অবৈধভাবে সংগ্রহ করা হয় না। নগদ টাকা দিয়ে গাছ কেনা হয়। কে বৈধভাবে কাটলো, আর কে অবৈধভাবে কাটলো তা দেখাতো আমাদের বিষয় নয়।
ইটভাটা প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ এর ৮ ধারায় কোথায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে, আর কোথায় যাবে না তার স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না খাগড়াছড়িতে। কিছু কিছু ইটভাটা ১২০ ফুট লম্বা কংক্রিটের তৈরি চিমনি দিয়ে চললেও বেশিরভাগ ইটভাটা চলছে ২৫ থেকে ৩০ ফুট লম্বা ড্রাম চিমনি নিয়ে। ইটভাটাগুলোর অব্যাহত ধুলি ও ধোঁয়ার কারণে ইটভাটার শ্রমিকের পাশাপাশি স্থানীয় শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও অ্যাজমাসহ নানারোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া কৃষি উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন বিষয়গুলো শক্তভাবে মোকাবিলা না করলে পরিবেশ ধ্বংস হবে।
প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশীল নেতারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে এসব ইটভাটা চালাচ্ছে। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহারের কথা থাকলেও খাগড়াছড়িতে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না।
ইটভাটায় ব্যবহার হচ্ছে ফসলি জমির মাটি ব্যবহারের কথা স্বীকার করলেও পাহাড় কেটে মাটি ইটভাটায় ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেন তারা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইটভাটার মালিকরা বলেন, যদি ধোয়া ও ধুলি থেকে লোকজন ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে প্রতিদিন কয়েকশ’ গাড়ি বাইরের জেলা হতে খাগড়াছড়ি আসছে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া এসব গাড়ি তেল পোড়াচ্ছে, ধুলা ও ধোঁয়া উড়াচ্ছে-তাতে কি কারও সমস্যা হয় না, সব কি শুধু ভাটা মালিকদের দোষ?
এদিকে বনের কাঠ ইটভাটায় পোড়ানো বন্ধে টাস্কফোর্স করে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য এলাকায় বন বিভাগের অনুমোদন ছাড়া কোনও গাছ কাটা ও পরিবহন সর্ম্পূণ নিষিদ্ধ। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে ইটভাটার অনিয়ম বন্ধ করা হবে।
জেলা প্রশাসক জানান, ইটভাটা মালিকেরা যদি প্রশাসনের নির্দেশনা না মানেন, তাহলে মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে ইটভাটা মালিকদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত বছর বেআইনিভাবে ইটভাটা চালানোয় বিভিন্ন ভাটায় ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ করলে এবার কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মো: নজরুল ইসলামের সাথে ইট তৈরির কাজ ও অবৈধ ইটভাটায় গাছ কেটে নিচ্ছে ফসলী জমি থেকে মাটি কেটে নিচ্ছে এসব বিষয় আইন লঙ্গন করে কাজ করছে এর কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে কিনা? তখন তিনি বলেন, প্রত্যেক উপজেলা আদেশ দেওয়া হয়েছে আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোথায় লাইসেন্স বিহীন ইটপোড়ানো হচ্ছে অথবা ইট তৈরি হচ্ছে এমন অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।