শিরোনাম
মঙ্গল. ডিসে ২৪, ২০২৪

জুমিয়াদের ধান তোলার মহাৎসব, সবুজ পাহাড়ে হাঁসছে সোনালী জুম

আল-মামুন, খাগড়াছড়ি:: সবুজ পাহাড়ের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ছুটে চলেছে। আপন মনে মেঘে করছে লুকচুরি খেলা। কখনো মেঘ আবার কখনো বৃষ্টি। এমন পরিবেশে ঝিরঝির বাতাসে দোলে জুমের পাকা ধান। প্রকৃতির এমন ছন্দে জুমের ফলন ভরে যায় জুম চাষিদের মন। পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী জুম থেকে পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার উৎসব শুরু হয়েছে। এই উৎসব চলছে পাহাড় জুড়ে। উৎসবে মেতেছে সকল বয়সিরা।

খাগড়াছড়ি সদরের জোড়া ব্রীজ, মাটিরাঙ্গা উপজেলার তেরাংতৈইবাকলাই (রিসাং) ঝরনা ও হাচুকপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জুম চাষি পরিবারের বড় সকল সদস্যরা মিলে জুমের পাকা ধান তোলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই ধান কাটার উৎসবে মেতেছে জুম চাষিরা। পড়ন্ত বিকেলবেলা খালুং ও বস্তা ভর্তি ধান নিয়ে ঘরে ফিরেন দল বেঁধে। জুমকে গিয়ে পাহাড়ের প্রত্যন্ত পাড়ার তরুণ-তরুণী ও নারী-পরুষদের এক মাস কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জুমে শ্রম দিয়ে নারী ৩০০ টাকা ও পুরুষরা ৫০০ টাকা পান।

খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কার্যালয় সুত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদ হয়েছে ১৭৮০ হেক্টর। উৎপাদন হয়ে ২৪৪২ মেঃ টন। মাটিরাঙ্গা উপজেলার হাচুকপাড়া এলাকার জুম চাষি কার্তিক চন্দ্র ত্রিপুরা বয়স ৬৬ বছর। তিনি ৫০ বছর ধরে জুম চাষ করছেন। তিনি বলেন, জুমে বার মাসে বার জাতের ফসল পাওয়া যায়। জুমে প্রথম ফসল আসে মারপা। এর পর প্রতি মাসে একটি দুইটি করে ফলন পাই। এখন ধান সংগ্রহ করছি। সবার শেষে হলুদ সংগ্রহ করব। এভাবে এই ফসল একটি বছর চলে যায়।

মাটিরাঙ্গা উপজেলার তেরাংতৈইবাকলাই (রিসাং) ঝরনা এলাকার জুম চাষি ত্রিদিপময় ত্রিপুরা ও গপিন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, গত বছর তুলনায় এই বছর জুমে ভালো ফলন হয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে জুমে ধানসহ অন্যান্য ফসলের বীজ বপন শুরু করেছি। আর এখন অক্টোবর মাসে পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। পাকা ধান খেতে সকাল-বিকেলে বানর ও টিয়া পাখির ঝাক নামে। ধান রক্ষা করতে বানর ও টিয়া পাখির ঝাক তাড়াতে হয়।

হাচুকপাড়া এলাকার জুম চাষি দিপন ত্রিপুরা বলেন, আমি যে বছর বিয়ে করেছি ওই বছর থেকে আমি জুম চাষ শুরু করেছি। পরীক্ষা করে দেখলাম কৃষি অফিস থেকে আমাদের যে ধান দিয়েছে এই ধানে ভালো ফলন হয়। জুমে এক আড়ি (১০ কেজি) ধান বপন করেছি তাতে ৪০ থেকে ৪৫ আড়ি ধান পাব। আগামী বছর এই জাতের ধান খোঁজ করব।

পুনর্বাসন এলাকার জুম চাষি অংক্রইপ্রু মারমা বলেন, বার জন শ্রমিক দিয়ে তিন দিনে জুমের ধান কাটা শেষ হয়েছে। বাড়িতে ধান মাড়াই কাজ চলছে। জুমে এই বছর এক আড়ি (১০ কেজি ) ধান বপন করেছি। তাতে পঞ্চাশ আড়ি ধান পাব বলে আশা করি। কলা, হলুদ, তিল জুমে আছে। মাটিরাঙ্গা উপজেলার তেরাংতৈইবাকলাই (রিসাং) ঝরনা এলাকার কারবারি অভিন্দ্র লাল ত্রিপুরা (৬২) বলেন, বা-মা, দাদা-দাদীরা জুম চাষ করে গেছেন। আমি ৪৪ বছরের বেশি হবে জুম চাষ করে যাচ্ছি। ৩ আড়ি (৩০ কেজি) ধান বপন করেছি। তাতে এক বছর গিয়ে আরো ধান বিক্রি করতে পারি। জুমে বিনি (কালো) ধান, কোম্পানি ধান, পাঁচ নম্বার ধান, হলুদ, ভুটাসহ বিভিন্ন জাতের সবজি ও তুলা রোপন করেছি।

মাটিরাঙ্গা সদর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড সদস্য শান্তিময় ত্রিপুরা বলেন, খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গা উপজেলাার আলুটিলা এলাকার সব ত্রিপুরারা জুম চাষের উপর নির্ভর। জুম চাষ করে জীবন-জীবিকা চলে। আগে আমাদের বা ও দাদুরা এক বছর জুম চাষ করলে এক বছর চলে যেতে। এখন ওই ভাবে ফলন হচ্ছে না। আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেছে। মাটি উর্বরতা কমে গেছে। আবার এখন প্রতি বছর বিভিন্ন ফল বাগান হওয়াতে জায়গাও কমে যাচ্ছে।

খাগড়াছড়ি খেজুরবাগান হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-সহকারি হর্টিকালচার অফিসার সুজন চাকমা বলেন, জুম চাষেও যতেষ্ট খরচ আছে। বিশেষ করে জঙ্গল কাটা, পরিস্কার করাতে শ্রমিকদের খরচ বেড়ে গেছে প্রান্তিক চাষিদের। পর্যাপ্ত পরিমাণ জুম চাষ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দেরিতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে আগাম বীজ বপন করতে পারছে না। তাছাড়া জুমের ফলন কমে যাচ্ছে।

পার্বত্য এলাকার জুম চাষিরা চিন্তায় পড়েছে যারা জুমের উপর নির্ভরশীল। তাঁরা এখন বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। একদিকে আবহাওয়াগত অন্য দিকে অর্থ সংকট। জুমের চাষকে যদি আমরা ধারণ করতে চাই লালন করতে চাই তাহলে সরকারি ভাবে প্রণোদনার ব্যবস্থা করে চাষিদেরকে উৎসাহীত করা যায় তবে আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। তিনি বলেন, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ফলজ বাগানের আওতায় এসে যাওয়ার কারণে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে জুমের জায়গা কমে যাচ্ছে।

পাহাড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আলতাফ হোসেন বলেন, এই বছর শুরুতে বৃষ্টি কম হলেও মাঝে খাগড়াছড়িতে বৃষ্টি ভালো হয়েছে। তাই জুমের ফলন ভালো হয়েছে। অনেক জুমে গিয়ে দেখলাম ভালো ফলন হয়েছে। এখন ধান কাটার সময় যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে ভালো ফলন পাবে। তিনি বলেন, জুমকে আধুনিকায়ন করা যায়। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আধুনিক উৎপাদন মুখী করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।

খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার বলেন, জুম চাষ খাগড়াছড়ি জেলার ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদ পদ্ধতি। এখানকার আদিবাসীরা যুগযুগ ধরে জুম চাষ করে আসছে। আবহাওয়া বৈরিতা কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জুম চাষিদের চাষ করতে বিলম্ব হয়েছে। পরর্বতী সময়ে বৃষ্টি হওয়াতে জুমের ফসল ভালো হয়েছে। বিশেষ করে তাদের নিজস্ব কিছু জাত ধান, শাক-সবজি মসলা ফসল ইত্যাদি এক সাথে চাষ করে। পর্যাক্রমে পরিপক্কতা হয়ে আসলে সংগ্রহ করে থাকে। এখন ধান পেকেছে তাই পাহাড়ি কৃষাণ-কৃষানীরা ধান তোলছেন। একেই সাথে অন্য সবজি সংগ্রহ করছেন। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আবার বাজারে বিক্রি করে থাকেন। ২০২২ অর্থ বছরে ১ হাজার ৫৯ হেক্টর জুম চাষ হয়েছে। কৃষি অর্থনৈতিতে জুম চাষের অবদান অনস্বীকার্য। কৃষি অধিদপ্তর কিছু সাবিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!