॥ আকাশ মনু-রাঙামাটি ॥ প্রত্যন্ত বলেই কি আমাদের শিশুদের পড়ালেখা করার অধিকার নেই? প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সমীপে এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে দেপ্পোয়াছড়ি গ্রামের বাসিন্দারা। রাঙামাটি জেলা শহরের অদূরেই অবস্থিত ছায়া সুনিবীড় এই গ্রামটির অবস্থান শহরের কাছে হলেও যাতায়াতের দুর্গমতার কারণে প্রত্যন্ত।
শতাধিক পরিবারের বসবাস থাকলেও কোনো সরকারি বা রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এলাকাবাসী নিজ উদ্যোগে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কোনোরকমে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে; সেই একমাত্র বিদ্যালয়টি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে লেখাপড়া করছে ৫২ জন শিশু। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে পরম মমতায় তাদের পাঠদান করে যাচ্ছেন ৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা, যাদের বেতন মাসিক ১৫শ’ টাকা।
রাঙামাটি জেলা শহর থেকে আনুমানিক ১০ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত দেপ্পোছড়ি ভেতর পাড়া গ্রামটি মূলত চট্টগ্রাম রাঙামাটি সড়ক এবং মানিকছড়ির কাছাকাছি। সদর উপজেলার ৩নং সাপছড়ি ইউনিয়নের এই গ্রামের শিশুদের পক্ষে রাঙামাটি শহর বা সাপছড়ি বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করাটা প্রায় অসম্ভব। তাই এলাকাবাসী ২০০২ সালে বিদ্যলয়টি চালু করে। কিন্তু ২০১৭ সালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের সময় বিদ্যালয়টির অফিস কক্ষ ভেঙে যায়, দীর্ঘ দুই দশকেও সংস্কার না হওয়ায় ক্লাসরুমগুলোও বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সাংবাদিক দেখে বিপুল উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এলো গ্রামের সব বয়সি নারী-পুরুষ। তবে তাদের মনে দারুণ ক্ষোভ, কারণ কেউ তাদের জন্য কিছু করেনি। অভিমান সাংবাদিকদের প্রতিও তারা কোনো রিপোর্ট করেনি বলে।
লোকেরা শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত, কারণ তাদের পড়া লেখার পরিবেশ দিতে পারছেনা। একটু বৃষ্টি হলেই ভিতরে পানি ঢোকে। দুই দশকের বেশি সময়ে অনেকের কাছেই ধর্ণা দিলেও এ বিদ্যালয়টি এখনো জাতীয়করণ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী। তাদের প্রশ্ন সরকারের সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গিকার কি তাদের জন্য নেই?
সরেজমিনে দেখা গেলো গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে শ্রেণিকক্ষে পানি ঢুকে কাঁদা সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যালয়টির অফিস কক্ষ ভেঙে গেছে। কাঁদাযুক্ত সেঁতসেঁতে অবস্থার কারণে এখন পাঠদান বন্ধ।
বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক নিরূপ কুমার চাকমা জানালেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাড়ার ছেলে-মেয়েরা যথারীতি বিদ্যালয়ে আসে। ২০০৯ সাল থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আসছে তারা, পাশের হারও শতভাগ।
এলাকার কারবারী জুরোমুনি চাকমা জানান, বর্তমানে বিদ্যালয়টি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। জনবহুল এলাকা হিসেবে সরকারীকরণ ও দ্রুত পূণঃনির্মাণ করা উচিত। মূলত স্কুলের পাশে যে কালর্ভাট আছে বৃষ্টি হলে সেখানে পানি ঢুকে আটকা পরে। কালর্ভাট উচু হলে পানি আর ঢুকতে পারবে না। যার ফলে স্কুলেও পানি প্রবেশ করতে পারবেনা।
বিষয়টি গোচরে ছিলনা জানিয়ে রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় জেলা পরিষদের কাছেও হস্তান্তরিত। কিন্তু উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয় এলজিইডি থেকে। উন্নয়ন কার্যক্রম এলজিইডি করে থাকে এর পরেও জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্কুলের বিষয়টা আমি দেখবো।
এ বিষয়ে রাঙামাটি উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার জগদীশ চাকমা জানান, দেপ্পোয়াছড়ি ভেতর পাড়া যে স্কুলটি ওটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমরা সরকারি বিদ্যালয়গুলো নিয়ে কাজ করি। বেসরকারি বিদ্যালয়ে আমরা বই দিয়ে থাকি। যদি সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা আসে তখন ওগুলো আমরা দিয়ে দিই। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে স্কুলটি আমাদের আওতার বাইরে। তারপরও সহযোগিতা যদি আমাদের করার থাকে আমরা করে যাবো।
তিনি বলেন, সরকারি পর্যায়ে বেসরকারি স্কুলগুলোর জন্য ওভাবে সহযোগিতা আসেনা। তাই আমরাও সহযোগিতা করিনা। ভিজিটের ক্ষেত্রে যদি বলি সরকারি বিদ্যালয় ভিজিট করি আমরা, মাঝে মাঝে আবার বেসরকারি স্কুলগুলোও দেখি। রাঙামাটি সদরে প্রায় ৯০টি সরকারি বিদ্যালয় আছে পাশাপাশি বেসরকারি বিদ্যালয়ও অনেক আছে। লোকবল কম থাকায় আমাদের পক্ষে সব বিদ্যালয়ে ভিজিট করা কঠিন হয়ে যায়।
শিক্ষকদের বেতন বাবদ জনপ্রতি মাসিক ১৫ শ’ টাকা অনুদান জেলা পরিষদ থেকে এলেও বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো সংস্থা থেকেই আর কোনো অনুদান আসেনি কখনও। ১৭ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিদ্যালয়টি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলে নতুন ভবন নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য জেলা পরিষদ বরাবরে আবেদন করেছিল এলাকাবাসী তবে সাড়া মেলেনি। সরকারের সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চতকল্পে বিদ্যালয়টি পুণঃনির্মাণ ও জাতীয়করণের মাধ্যমে এই পরিবারগুলোর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকার কাটাতে কর্তৃপক্ষের সু-নজর কামনা করেছে এলাকাবাসী।