ডেস্ক রির্পোট::: ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, রাত তখন আড়াইটা। লে. মুশফিকের রেডিয়াম হাত ঘড়িটা সময় জানান দিচ্ছে। ঠিক চার ঘন্টা আগে লক্ষীছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে ১৭ জন রেইডার্স নিয়ে চেলাছড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছিলেন তিনি। ক্যাম্প থেকে আসতে আসতে অনেক চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে। পাহাড়ী পথ দুর্গম, বিপদসংকুল। কিন্তু অতি উৎসাহে স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগেই তারা পৌঁছে গেলেন লক্ষ্যস্থলে। সেদিনের মেঘলা আবহাওয়াও যেন তাদেরই অনুকূলে। কিন্তু পরিস্থিতি যেন হাতছাড়া না হয়, সেজন্য সিন্দুকছড়ি ক্যাম্প থেকেও সেকেন্ড লেঃ সাইদ আর একটি দল নিয়ে উল্টাছড়ি গ্রামের পাশে পজিশন নেন। শত্রুর সাথে সংঘর্ষ এখন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। সোর্সের সহায়তায় পাহাড়ের পাদদেশে আর চূড়ায় দুটি জুম ঘর শনাক্ত করলেন লে. মুশফিক।
সোর্সের ভাষ্যমতে, এ দুটি ঘরেই সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অবস্থান করার কথা। দুটো উপদলকে পাহাড়ের পাদদেশে পজিশন নিতে বলে নিজে ৫ জনসহ চলে গেলেন পাহাড়ের চূড়ায়। জুম ঘর থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে লে. মুশফিক শুয়ে আছেন তার দলসহ। এখন শুধু প্রতিপক্ষের অপেক্ষা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে দেখা হয়ে গেল দুই পক্ষের। মুহূর্তের মধ্যে রণক্ষেত্র হয়ে গেল সেই পাহাড়চূড়া। শুরু হয়ে গেল ভয়ানক যুদ্ধ। শত্রুর প্রথম বুলেটটাই নিজের বুকে নিলেন লে. মুশফিক। যুদ্ধ শেষ করে সবাই লে. মুশফিকের চারপাশে ডিফেন্স নিলো। উদ্ধার হলো শান্তিবাহিনীর ইউনিফর্ম পড়া তিনটি মৃতদেহ, দুটো রাইফেল, একটি এসএমজি। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে লে. সাইদ ততক্ষণে লে. মুশফিকের কাছে পৌছে গেলেন। মুশফিকের মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন সময় খুব কম।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির তরুণ অফিসার লে. মুশফিক। ১৯৮৯ সাল, ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত। প্রায় প্রতিদিনই শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্নস্থনে সংঘর্ষ চলছিল তখন। কিন্তু এত কিছু উপেক্ষা করেও দেশের জন্য জীবনবাজী রেখে দুঃসাহসী সেনাসদস্যরা নিয়মিত অপারেশন চালিয়ে গিয়েছে। প্রাণঘাতী এক একটা অপারেশন ছিল দুঃসাহসিক বীরত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এদিকে আঁধার কেটে গিয়ে দিবালোক যখন প্রখরতর হয়ে উঠছে, মুমুর্ষ মুশফিকের চারপাশে তখন নিকষ আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। প্রথমে মা, তারপর বাবার মুখ ভেসে উঠল; তারউপর আঁধার মেঘ ফুঁড়ে তিনটা চেনা মুখ উকি দেয়; হাতছানি দিয়ে ডাকে হাবিলদার হারুন, ল্যান্স নায়েক সুনিল আর ডিএমটি নাজমুল হুদা। তখন থেকে ঠিক নয় দিন আগে বাঘাইহাট থেকে ১০ নম্বর ক্যাম্পে যাবার পথে এই শান্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে এরা তিনজন প্রাণ হারিয়েছিল। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে, তবু অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়া রানারকে সান্তনা দিতে গিয়ে মুশফিক বলে উঠেন, “তোমার তো সংসার আছে, পরিবার আছে, তুমি মারা গেলে তাদের কি হবে ? আমি মরলে এদেশের কারো কোন ক্ষতি হবে না।”
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, সকাল ৮টা বেজে ১৫ মিনিট । লে. সাইদ ছুটলেন হ্যালিপ্যাড বানাতে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই হেলিকপ্টার ছুটে এলো। হলুদ উইন্ড শকসটা পতপত করে উড়ছে, দূর দিগন্তে হন্তদন্ত হয়ে উড়ে আসা হেলিকপ্টারটা ক্রমশ বড় দেখাচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। মুশফিক ততক্ষণে হারুন, সুনীল আর নাজমুল হুদাদের সাথে মেঘেদের দেশে।
সাতক্ষীরার ছেলে মুশফিক সুদুর পার্বত্য চট্টগ্রামের অচেনা এক সবুজ পাহাড়ে তার রানারের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। অসহায় রানার থেমে থেমে আক্ষেপে বলে উঠছে, “গুলিটা আমার গায়ে ক্যান লাগল না স্যার ?
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, দেশমাতৃকার অখন্ডতা রক্ষায় এভাবেই নিজের জীবন বিসর্জন দেন লে. মুশফিক। ২৪ সেপ্টেম্বর তাকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
অপারেশন উত্তরণের পূর্ব পর্যন্ত সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল অত্যন্ত ঝ্ুঁকিপূর্ণ এবং আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করা। এজন্য সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তাবাহিনীর অনেক সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছে। দেশের জন্য অখণ্ডতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেসকল ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে গিয়ে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। অনেকে বরণ করে নিয়েছে স্থায়ী পঙ্গুত্ব। এমনই একজন বীর সৈনিক হলেন শহীদ লেঃ মুশফিক বীরউত্তম। বীর সৈনিক শহীদ লেঃ মুশফিক বীরউত্তমকে স্মরণ করে খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারায় স্থাপন করা হয়েছে শহীদ লেঃ মুশফিক উচ্চ বিদ্যালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় । এছাড়াও গুইমারা রিজিয়নে নির্মাণ করা হয়েছে তার ভার্কায্য ও হলরুমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। দেশের জন্য পাবর্ত্য অঞ্চলের জন্য অসহায় সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিদের জন্য তার এই আত্মত্যাগ কখনোই ভুলার নয়।
ইনসার্জেন্সী অপারেশনের ইতিহাসে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উল্লেখযোগ্য নাম। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি এখন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মূলত এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র অংশের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইনসার্জেন্টদের উৎখাত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সাল থেকে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালিত হয়ে আসছে। এজন্য সেসময় থেকেই সেনাবাহিনী বিশেষভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েন রয়েছে এবং সেসময় থেকেই তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করে আসছে। এ অপারেশন পরিচালনা করতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকেও সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষার জন্য বেশ চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছিল অসংখ্য নিরীহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বাঙালী সম্প্রদায়ের মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। বর্তমানে একই ধরনের কার্যক্রম ইউপিডিএফ, জেএসএস এবং সংস্কারবাদী দলের সন্ত্রাসীরা সবাই মিলে করছে। তথ্য মতে, শুরু থেকে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের আক্রমণে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৫৩ জন প্রাণ দিয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪৫২ জন এবং ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ২৫৫ জন। এদিকে ৩০ জুন ২০১৫ পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০৯৬ জনকে হত্যা, ১৮৮৭ জনকে আহত এবং ২১৮৮ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এর প্রায় এক তৃতীয়াংশ পার্বত্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা এবং শান্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এভাবেই প্রাণ দিয়ে গিয়েছেন আমাদের বীর সেনানিরা। তারা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। তাদের দেশপ্রেম, ত্যাগ, বীরত্বগাঁথা ও চেতনা বুকে লালন করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই হোক প্রতিটি বাংলাদেশীর ব্রত।সংশোধনী লেখক মো: নুরুল আলম।