নিজস্ব প্রতিবেদক:: অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বিবেচনায় পাহাড়ি জনসাধারণকে করের আওতা থেকে মুক্তি দিয়েছে সরকার। কিন্তু কর দিতে না হলেও সন্ত্রাসী সংগঠনের চাঁদার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ। হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দকৃত উন্নয়ন কাজে বাধাঁগ্রস্ত হচ্ছে উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিশাল পরিমানের চাঁদার দাবি মিটাতে গিয়ে।
বাঙালি কিংবা উপজাতি- সবাই এসব সন্ত্রাসীকে চাঁদা দিতে বাধ্য। বিভিন্ন ফসল, ফল এমনকি মুরগি ও মুরগির ডিম বেচাকেনা হলেও চাঁদা আদায় করছে সন্ত্রাসীরা। সড়ক উন্নয়নে চাঁদা দাবি করার মূল উদ্দেশ্য হলো সড়ক মেরামত ও ব্রিজ নির্মাণ হয়ে গেলে মানুষের চলাচলে সুবিধা হবে আর সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অবৈধ কর্মকান্ড করতে ব্যঘাত ঘটবে।
বর্তমানে প্রকাশ্যে চিঠি দিয়েও চাকরিজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে তারা। প্রাণভয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনের কাছে এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে অভিযোগ করছে না কেউ। অভিযোগ এলেও প্রমাণের অভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে জড়িতরা। পার্বত্য তিন জেলা ঘুরে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইতিপূর্বে বান্দরবান জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক পার্বত্যাঞ্চলের আঞ্চলিক তিন সংগঠন সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির চিত্র প্রকাশ্যে তুলে ধরেন।
সভায় তিনি বলেন, প্রতিটি বাসকে জেএসএসের বছরে ৫ হাজার টাকা করে এবং ইউপিডিএফকে ৩ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি খাতের পণ্য বেচাকেনায় চাঁদা আদায় করছে সন্ত্রসীরা। ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীরাও চাঁদার আওতার মধ্যে রয়েছেন। গ্রামের চাষীরা বাজারে আনারস, কাঁঠাল, আমসহ বিভিন্ন ফল ও ফসল বিক্রি করলে সেখান থেকেও চাঁদা দিতে হচ্ছে তাদের। একটা কাঁঠাল বিক্রি হলে ৫ টাকা ও কলার ছড়িতে দিতে হয় ৫ টাকা করে চাঁদা। এমন কোনো আইটেম নেই যেখানে চাঁদা দিতে হয় না।
সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চল ঘুরে দেখার সময় আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) এবং ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের অপহরণ ও চাঁদাবাজির চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এ তিনটি সংগঠনের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন তিন জেলার সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিরা।
ইতিপূর্বে রাঙ্গামাটি জেলার জেএসএস এর এক সদস্য অফিস আদালতে গিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে চাঁদা দাবি করে আসছে। জেলার বাহিরে থেকে লোকজন গেলে এমনকি সাংবাদিকরাও রেহায় পায়না এদের হুমকি ধামকি থেকে। পত্রিকার ভূয়া প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল উত্তোলন করে নিয়ে যায় এই জেএসএস সদস্য।
নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ মাঝে-মধ্যে চাঁদাবাজদের আটক করলেও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। অভিযান কঠোর হলে নতুন উপায়ে চাঁদা আদায় করা হয়। এদিকে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কিংবা না দিলে প্রাণনাশের পাশাপাশি নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এ কারণে পার্বত্য এলাকার মানুষের মাঝে এখন বিরাজ করছে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর ‘চাঁদা আতঙ্ক’।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে উপজাতি সশস্ত্র গ্রুপ এক থেকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে। বছর শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪শত কোটি। চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। আদায় করা চাঁদার টাকা দিয়েই দলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রেশন, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি দেয়া হয়। এছাড়া পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চাঁদার এ অর্থ দিয়ে দেশ-বিদেশে বাঙালিবিদ্বেষী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজ করে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক পার্বত্য খাগড়াছড়ির এক ব্যবসায়ী বলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি অহরহ ঘটছে। চাঁদাবাজিতে তারা কেউ পিছিয়ে নেই। কোনো পরিবহন মাল নিয়ে খাগড়াছড়ি ঢোকার সময় অথবা বের হওয়ার সময় চাঁদা দিতে হয়। একেক সময় তারা একেক স্থান থেকে চাঁদা তোলে। চাঁদা না দিলে গাড়ি থামিয়ে স্টাফদের মারধর করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। চাঁদা না দেয়ায় সম্প্রতি বিআরটিসি’র একটি ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় ইউপিডিএফ।
জানা যায়, ১৮ অক্টোবর ২০২০ সালে খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়ি থেকে গুইমারা সড়কে তিনটি ব্রিজ নির্মাণে ১৫ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা বাজেট ঘোষনা করা হয় এছাড়া সিন্দুকছড়ি, নাক্রাই ও গুইমারা বাজারের সড়ক মেরামতের জন্য ৩০ জুলাই ২০১৯ সালে ৫ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা বাজেট ঘোষনা করা হয় কিন্তু এসকল বাজেটের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বেই উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনের তোপের মুখে পড়ে ইতেমধ্যেই কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। উন্নয়নের কাজে চাঁদাবাজি সহ নানা হুমকির সম্মুখিনের পড়ায় কাজ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে প্রায় সকল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
এই বিষয় গুইমারা উপজেলা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান বলেন, ব্রিজ ও সড়ক মেরামতের জন্য ২০১৯ সালে এবং ২০২০ সালে বাজেট হয়েছিল কিন্তু কিছু চাঁদিবাজী সংগঠনের চাঁদা দাবির কারনে বর্তমানে কাজ বন্ধ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ব্রিজ ও সড়ক নির্মাণ কাজটির বাজেট অতিশিগ্রই বন্ধ হওয়া যাওয়ার উপক্রমে রয়েছে।
এই বিষয়ে গুইমারা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মেমং মারমা বলেন, উন্নয়নের কাজ গুলো কারা হতে দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে জনগণ কথা বলতে হবে। না হয় এভাবে উন্নয়ন কাজে বাঁধা গ্রস্থ্য হচ্ছে। বর্তমানে সিন্দুকছড়ি থেকে নাক্রাই হয়ে গুইমারা পর্যন্ত কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সচেতন মহলের অভিমত, পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নের বাজেট হচ্ছে তবে চাঁদাবাজী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তান্ডবে উন্নয়ন হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল। অতিদ্রুত এসব চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জরুরী বলেন দাবি করেন।