নিজস্ব প্রতিবেদক:: পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা কারণে দুইশত পর্যটক পথ প্রদর্শক, শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট, হাজারো নৌকার মাঝি কর্মসংস্থান হারিয়ে আজ না খেয়ে আছে। পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ২ হাজার পরিবারের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ নানাবিধ সমস্যা জর্জরিত হচ্ছে’।
বান্দরবানে থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে এ তিন উপজেলার সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনের উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে এ তিন উপজেলার লক্ষাধিক অধিবাসীকে। কেএনএফের ভয়ে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছে।
কেএনএফ সদস্যরা স্থানীয়দের চলাচলের রাস্তায় গাছ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা ও কয়েকটি সেতুর পাটাতন ভেঙ্গে দেয়ার যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে স্থানীয়রা উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও ক্রয় করতে পারছেনা। এছাড়া ছেলে-মেয়েদের বিদ্যালয়ের পাঠানো, অসুস্থ হলে চিকিৎসা জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারছে না। রয়েছে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা। সবমিলিয়ে পাহাড়ের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
সূত্রে জানা যায়, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সংগঠনটি সমতল অঞ্চলের জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এমন খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী গত অক্টোবর থেকে পাহাড়ে অভিযান চালান। অভিযানের সময় থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি তিন উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। বর্তমানও এ নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞার ফলে রুমা উপজেলার ৪নং রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের লুংওয়ের পাড়া, পাইনোওয়াম পাড়া, সলোপি পাড়া, দুলিচাং পাড়া, থামলো পাড়াসহ কয়েকটি পাড়ার বাসিন্দাদের চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ওই সকল গ্রামবাসীর রুমা উপজেলার দূরত্ব বেশি হওয়ায় কারণে থানচি বাজারে থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে এমনটায় জানায় স্থানীয়রা।
গত ১১ মার্চ বম পাড়া নামক স্থানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা সরকারের উন্নয়ন কাজের শ্রমিকের উপর আতর্কিত গুলিবর্ষণ করে। এতে দুইজন নির্মাণ শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও ৪ জন শ্রমিক আহত হয়। এছাড়াও ১২ মার্চ একই স্থান থেকে মোট ২১ জন শ্রমিকসহ ঠিকাদারকে অপহরণ করে এবং দুই দিন পর ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া রাস্তায় গাছ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা, সেতুর পাটাতন ভেঙ্গে দেয়াসহ নানা কর্মকাণ্ডের জন্ম দেয় সংগঠনটি। এতে থানচি উপজেলার ২নং তিন্দু ইউনিয়নের ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডসহ ৩০-৩৫টি পাড়াবাসী দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
গত রবি ও সোমবার ২ ও ৩ মার্চ দুইদিনব্যাপী থানচি বাজারে সাপ্তাহিক হাটবার। বাজারে আসা সিৎলাংপি পাড়া, রেমং পাড়ার বেশ কয়েক পুরুষ ও নারীর সাথে দেখা হয়ে কৌতুহলের সাথে সেখানকার অবস্থার কথা জানতে চাইলেই তারা নিজেদের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় কী যেন বলাবলি করেন। পরে কিছুই হয়নি, সব ঠিক আছে বলে প্রথমে এড়িয়ে যান।
এতে কৌতুহল আরো বেড়ে যায়। সুকৌশলে নিরিবিলি স্থানের ডেকে নিয়ে জানতে চাইলেই নাম প্রকাশ না-করার শর্ত দিয়ে তারা বলেন, “আমরা খুব একটা ভালো নেই”।
এছাড়াও তারা জানান, “স্থানীয় ৩০ থেকে ৩৫টি গ্রামের মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। জুমের চাষাবাদ ঠিক করে করতে পারছে না। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্যদের খাবার জন্য তাদের ঘরের খাদ্য ও গৃহপালিত পশুপাখি দিতে হয় তাদের। কখন যে কী হয় বলা খুবই কঠিন। আমাদের ছেলে মেয়েদের ঠিকমত স্কুলের পাঠানো যাচ্ছে না। আমরাও বাজারে নির্ভয়ে যাতায়াত করতে পারছি না। এছাড়া জুমের ও ফলজ বাগানের উৎপাদিত কলা, কাজুবাদাম, আম, হলুদ, বাদাম, তিল,মরিচসহ কোন কিছু ক্রয় বিক্রয় করতে পারছি না”।
তারা আরও জানান, ”কয়েকজন সর্তকতার সাথে থানচি বাজারে পৌঁছলেও পরিবহন ব্যবস্থা না থাকার কারণে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারছে না। এছাড়া গ্রামের রাস্তাগুলোতে গাছ এবং অন্যান্য জিনিস দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ কোন প্রয়োজনে বাইরে বের হতে পারছে না তারা। এসব এলাকার লোকজন গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা জানান, এসব এলাকার বাসিন্দাদের জুম-বাগানে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে হলে অনুমতি লাগে। এখন ফসল বিক্রি করতে না পারলে না খেয়ে মরতে হবে”- বলেও জানান তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে থানচি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি বলেন, ‘পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশকে শান্ত করতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সার্বক্ষণিক কথা বলছি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এলাকায় শান্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা চলমান রয়েছে। শীঘ্রই একটা সিদ্ধন্তের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে’।