–—— মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন
আপনারা যদি যুদ্ধ করতে চান, আসুন যুদ্ধ করি। আপনারা এক হাজার দুই হাজার তিন হাজার লোক নিয়ে, আর এই ক’টা অস্ত্র নিয়ে আমাদের সাথে যদি যুদ্ধ করতে চান, আধা ঘন্টাও টিকতে পারবেন না।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন বলেছেন, কোটা যদি থাকে সে কোটা সবার জন্য হতে হবে। উপজাতি, অউপজাতি যারা পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাস করেন, তাদের সবার জন্য এই কোটা প্রযোজ্য হতে হবে। আমি এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধম্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানাতে চাই, এই পার্বত্য কোটা, এটা উপজাতি, অউপজাতি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিন।
গত ২৬ মে রাঙামাটিতে এপিবিএন আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধনকালে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির তার বক্তৃতায় আরো বলেন, সবকিছুর প্রথমবার আছে। তাই আমি প্রথমবার আপনাদের এড্রেস করবো। জিওসি ২৪ পদাতিক ডিভিশন হিসেবে আমার বক্তব্য রাখার আগে আমি এই পার্বত্য চট্রগ্রামের সাথে আমার পরিচিতি তুলে ধরবো। আপনারা অনেকে হয়তো আমাকে আগে দেখেছেন। অনেকে মাঝ বয়সে দেখেছেন। আমি আমার চাকরির শেষ পর্যায়ে। এখানে জিওসি ২৪ পদাতিক ডিভিশন শেষ পর্যায়ে দেখছেন।
প্রথম পর্যায়ে যারা দেখেছেন, তারা খাগড়াছড়িতে দেখেছেন। যখন হংসধর চাকমা আমার ড্রাফট করা চিঠি নিয়ে যেতে ওপারে রূপায়ন বাবুর কাছে, সংলাপ করার জন্য। সংলাপ সবসময় প্রাথমিকভাবে নিচের লেভেল থেকে শুরু হয় এবং এর পরিণতি আলহাদুলিল্লাহ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিলেন।
তিনি বলেন, আমি আপনাদেরকে আমার বক্তব্যের শুরুতে আমরা কোন স্বাধীন হলাম, আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্রটা কী, মূল নির্দেশনা কী, মূল চেতনা কী, সেটার দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। আমরা যদি একটি দেশের স্বাধীন নাগরিক হই, তাহলে আমাদের স্বরণ করতে হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চে সেই বিখ্যাত ভাষণকে। তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
সে মুক্তি চেয়েছিলাম আমরা। মুক্তি কারা চেয়েছিলাম? মুক্তি কি শুধু পার্বত্য চট্রগ্রামের বাইরে যারা তারা চেয়েছিলাম? পার্বত্য চট্রগ্রামের যারা বাস করেন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খিয়াং, লুসাই, খুমি- তারা কি মুক্তি চান নাই? আজকে আমরা যদি চিন্তা করি আমাদের কি মুক্তি হয়েছে? পার্বত্য চট্রগ্রামের জনগণের মুক্তি হয়েছে? মুক্তি জিনিসটা কী? মুক্তি জিনিসটাকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। চাহিদা দেখে মুক্তি। আমার খাবার দরকার, আমার বাসস্থান দরকার, আমার শিক্ষা দরকার, আমার চাকরি দরকার- এগুলো হচ্ছে আমার বেঁচে থাকার জন্য চাহিদা । এই চাহিদা থেকে আমরা অনেকখানি মুক্তি পেয়েছি, সরকারের সদিচ্ছার কারণে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে উন্নয়নের গতি ধারার কথা ড. বেনজির আহমদ বললেন, তার কারণে। কিন্তু অপর যে আরেকটি আমাদের মুক্তির অংশ, তা ভয় থেকে মুক্তি । সে ভয় থেকে মুক্তি কি আমরা পেয়েছি?
জেনারেল সাইফুল আবেদীন বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্থাপিত হয়েছে শান্তি স্থাপন করার জন্য। তার মানে কি শান্তি আমাদেরকে ভয় দূর করে রাখবে। কিন্তু সেই ভয় থেকে কি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বা পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠী আজকে মুক্ত হতে পেরেছি? আমরা পারিনি। কেন পারিনি? কারণ আমাদের শান্তিচুক্তি সঠিকভাবে পালন করা হয়নি, বাস্তবায়ন করা হয়নি। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়নি কেন? শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা দায়িত্ব কার ছিল? শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা দায়িত্ব কি শুধু মাত্র সরকারের? কোন চুক্তি কি একপাক্ষিক? সব চুক্তি দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক। এক পক্ষ অন্য পক্ষের সাথে চুক্তি করে।
আমরা কি চুক্তিটা কি সেটা জানি? চুক্তির কতগুলো ধারা, কতগুলো উপধারা আমরা পড়েছি? ৭২ টি ধারা এবং ৯৯টি উপধারা দিয়ে একটি চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তির মধ্যে সরকারের জন্য পালনযোগ্য সবকিছু এবং জনসংহতির জন্য পালনযোগ্য ছিল মাত্র দুটি ধারা। ঘ খণ্ডের অনুচ্ছেদ ১৩ এবং অনুচ্ছেদ ১৪ যেখানে বলা আছে জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্রগ্রামে তৎকালীন তাদের সকল অস্ত্র সারেন্ডার করবে এবং তাদের সকল আর্ম ক্যাডার আত্মসমর্পণ করবে। মাত্র দুটি ধারা জেএসএসের জন্য। এই দুটি ধারার মধ্যে কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?
আপনারা বলেন, এই দুটি ধারার একটিও কি বাস্তবায়িত হয়েছে? হয় নাই। সরকারের ৬৯টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে, বাকি ৩০টির মধ্যে ১৫টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৫টি বাস্তবায়ন হওয়ার অপেক্ষায় আছে। তাহলে সদিচ্ছা কার নাই? সরকারের নাই? নাকি আপনাদের নাই? এই বিষয়টির বিবেচনা ভার আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম।
জিওসি ২৪ পদাতিক ডিভিশন বলেন, আজকে আপনারা একটি দল থেকে বিভক্ত হয়েছে বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়েছেন। পার্বত্য চট্রগ্রাম ভাগ করে নিয়েছেন নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জায়গা হিসেবে। সরবে এবং নীরবে চাঁদা আদায় করছেন। যাতে অতিরিক্ত অস্ত্র আনতে পারেন। আধিপত্যের বলয় বাড়াতে পারেন। নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে পারেন এবং জনগণকে অতিষ্ঠ করে রাখতে পারেন। আমি জনগণকে আহ্বান জানাবো, আপনার ভয় পাবেন না। আজকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৭৪ এর সেনাবাহিনী না। আজকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৯০ এর সেনাবাহিনী না।
ড. বেনজির আহমদ বলেছেন, আপনারা আমাদেরকে জানান, আপনারা আমাদের তথ্য দিন। আপনারা আমাদের কাছে নিরাপত্তা চান। অনেক সময় দেখা গেছে যে, আপনাদের অপহরণ করা হচ্ছে, আপনারা জানাতেও চান না। আপসে টাকা দিয়ে চলে আসছেন। এটা যদি আপনি নিজে করেন ব্যক্তি হিসেবে, তারপর আপনি আমাদের ব্লেম করতে পারেন না যে, এখানে নিরাপত্তা বাহিনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। আপনারও তো নাগরিক হিসেবে অধিকার আছে, সেটা বলেন। সেটা করেন।
তিনি বলেন, চট্রগ্রামে এই মুহূর্তে ৫১ শতাংশ উপজাতি নাগরিক এবং ৪৯ শতাংশ অউপজাতি নাগরিক বসবাস করেন। আজকে এখানে যেকোন প্রক্রিয়া যে কোন শান্তি স্থাপনের জন্য অউপজাতি নাগরিক যারা তাদেরকে বাদ দিয়ে কোন প্রকার শান্তি স্থাপন করা সম্ভব হবে না এবং কেউ যদি বলেন, অউপজাতি নাগরিককে বাংলাদেশের অন্য কোন যায়গায় নিয়ে যেতে হবে, তাহলে সেটা হবে একটা আকাশ কুসুম কল্পনা। সুতরাং আপনাদের নেতৃবৃন্দের মাঝে যারা এরকম বলে থাকেন, এরকম চিন্তা করে থাকেন, তাদেরকে আমি সেখান থেকে সরে আসতে অনুরোধ জানাবো এটা কখনই সম্ভব হবে না এবং এটা কোন গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব নয়।
আজকে আপনারা অত্যন্ত শিক্ষিত। বাংলাদেশের জাতীয় গড় শিক্ষার হার ৭৩.৯১ শতাংশ। সেখানে এই পার্বত্য চট্রগ্রামের বাঙালিদের গড় শিক্ষার হার ২৩ শতাংশ। পার্বত্য চট্রগ্রামে চাকমা ছাড়া অন্যান্য গোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৪৪.৬২ শতাংশ । চাকমাদের শিক্ষার হাত ৭৩ শতাংশ। আপনারা কীভাবে এত শিক্ষিত হচ্ছেন? বিভিন্ন বড় বড় জায়গায় আপনাদের অবস্থান। কেন আপনাদের অবস্থান? দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় আপনাদের উপস্থিতি। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিানের কাছে আপনাদের সরব পদচারণা। কেন?
কারণ আপনারা সরকারের অনুগ্রহ করে দেওয়া কোটা ব্যবস্থা পূর্ণ অপব্যবহার করছেন। সবকিছুতে কোটা। কোটা যদি থাকে সে কোটা সবার জন্য হতে হবে। উপজাতি, অউপজাতি যারা পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাস করেন, তাদের সবার জন্য এই কোটা প্রযোজ্য হতে হবে। আমি এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধম্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানাতে চাই, এই পার্বত্য কোটা, এটা উপজাতি, অউপজাতি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিন। তার পর দেখুন প্রতিযোগিতায় কারা এগিয়ে আসতে পারে।
জেনারেল আবেদীন আরো বলেন, আপনারা যদি যুদ্ধ করতে চান, আসুন যুদ্ধ করি। আপনারা এক হাজার দুই হাজার তিন হাজার লোক নিয়ে, আর এই ক’টা অস্ত্র নিয়ে আমাদের সাথে যদি যুদ্ধ করতে চান, আধা ঘন্টাও টিকতে পারবেন না। আমরা সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিজিবি মিলে যারা আছি, তাদের সাথে আপনারা ৩০ মিনিট যুদ্ধ করেন। আসেন, বলেন, জায়গা ঠিক করি। আপনারা পাহাড়ে পাহাড় লুকিয়ে থাকবেন, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অত্যাচার করে খাবার খাবেন। রাতের বেলায় এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে লুকিয়ে থাকবেন, আর দুর থেকে আমাদের গুলি করবেন এটা কোন যুদ্ধ হল না। এটা হল মার্সেনারি অ্যাকটিভিটিস, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ।
আজকে এই এলাকা দুর্গম বলে আপনার সুবিধা পাচ্ছেন। এলাকার সুবিধা আপনারা নিচ্ছেন। আজকে যদি বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো হত, তাহলে আমাদের প্রয়োজন হত না। যেকোন বাহিনী এমনকি আনসার বাহিনী আপনাদের শায়েস্তা করে দিতে পারতো।
আমি চাই, প্রধানমন্ত্রী যে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছেন, আমরা সবাই সেই শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসি। কেননা উনি বলেছেন, “আমরা পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করেছি এবং তা পূর্ণ বাস্তবায়ন করবো।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমি আশা করবো, সরকারের পক্ষ থেকে যে কয়টি ধারা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি সেটি বাস্তবায়নের আগে যারা অস্ত্রধারী আছেন তাদের জন্য মাত্র যে দুটি ধারা রয়েছে, সে দু’টি ধারা আপনারা বাস্তবায়ন করেন। আপনারা অস্ত্র সমর্পণ করেন এবং নিজেদেরকে আমাদের হাতে সোর্পদ করেন। আর না হলে যেকোন মূল্যে আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে আপনাদের বিরুদ্ধে যে প্রকার, যেকোন প্রকার সেক্রিফাইস করা প্রয়োজন, যেকোন প্রকার আত্মদান করা প্রয়োজন, তা করতে প্রস্তুত আছি। আমরা আত্মদান করেছি, আমরা রক্ত দিয়েছি, আমরা আরো রক্ত দিবো। কিন্তু আপনাদেরকে আপনাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে কখনোই সফল হতে দেবে না। ২৬ তারিখের ব্যাটালিয়ন আর্মড পুলিশের ক্যাম্প স্থাপনে রাঙ্গামাটি পুলিশ লাইন সমাবেশে এ কথা বলেন, মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন ।