নিজস্ব প্রতিবেদক: পাহাড়ের তিন জেলায় বাজার ফান্ড ব্যাংক ঋণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতির চাকা। বেকার হয়ে পড়ছে অনেক ছোট-বড় শ-শ ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকিং কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রভাব পড়ছে আত্মসামাজিক উন্নয়নে।
আইনে বাধা না থাকলেও অলিখিতভাবে তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক কার্যলয় থেকে ভূমি বন্ধকের অনুমতি আটকে রাখায় এই জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিষয়টিকে ব্যবসায়ীরা ‘আমলাতান্ত্রিক ইগো’ হিসেবে উল্লেখ করে এ বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তা না হলে সহসাই পাহাড়ে অভাব অনটন দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির পর দুইশ‘ বছর যাবত জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার ধারাবাহিকতা চলে আসলেও হঠাৎ করে ওই আইনের অজুহাতে ঋণ কার্যক্রম বন্ধ রাখাটা যেমন অযৌক্তিক তেমনি অমানবিকও। পাশাপাশি এর মাধ্যমে সরকারের এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষমাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার সুক্ষ ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাজার ফান্ড এলাকার জমি নিয়েই মূলত এই জটিলতা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগের ভিত্তিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলাপ্রশাসনগুলোর নিরবতায় তিনজেলায় অন্তত ১৩০ থেকে ১৪০ কোটি টাকার ঋণ কার্যক্রম আটকে আছে। যে টাকার প্রবাহ চালু থাকলে গত দুই বছরে পাহাড়ের অর্থনীতি আরো অনেকদুর এগিয়ে যেতে পারতো।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই জটিলতায় শুধুমাত্র রাঙামাটির বাজার ফান্ড এলাকাগুলোতেই ৫০ কোটি টাকার ঋণ কার্যক্রম আটকে আছে; এ তথ্য ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া। ঋণ নিতে না পেরে ইতিমধ্যেই রাঙামাটি থেকে অন্তত ৪০ জন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি ব্যবসা বাণিজ্য গুটিয়ে রাঙামাটি থেকে অন্যত্র চলে গেছেন; এমন অভিযোগ রাঙামাটি চেম্বার নেতৃবৃন্দ থেকে জানানো হয়েছে।
একই সাথে ব্যাংকগুলো তাদের সরকার নির্ধারিত লক্ষমাত্রা অর্জনেও ব্যর্থ হচ্ছে বলে রাঙামাটির ১৭টি ব্যাংকের অনেকগুলোর ব্যবস্থাপকগণ জানিয়েছেন।
সোনালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক ম্যানেজারগণ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, এই জটিলতায় নতুন ঋণ যেমন দেওয়া হচ্ছে না, তেমনি পুরাতন ঋণ নবায়নের কার্যক্রমও স্থগিত রয়েছে। এতে কপর্দকহীন হয়ে পড়েছে অনেক ব্যবসায়ী। কারণ তারা ঋণ নবায়নের আশায় ধারদেনা করে ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে আগের সকল টাকা জমা দিয়ে নতুন ঋণের জন্য আবেদন করেছেন। এখন তার ফাইল আটকে যাওয়ায় তারল্য সঙ্কটে ধুকে ধুকে সময় পার করছেন তারা। এরফলে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করাও সম্বভ হচ্ছেনা ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে।
বাজার ফান্ড আইনে সরকারি জমি বাজার ফান্ডের অর্ন্তভূক্ত করে যথাযথ নিয়মানুসারে নাগরিকদের অনুকূলে বন্দোবস্তি প্রদান করা হলেও আশ্চার্যজনকভাবে খাগড়াছড়ির ডিসি এসব জমিকে খাসজমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যংক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, খাগড়াছড়ির ডিসি আইনের কিছু ধারা পড়েছেন আর কিছু ধারা পড়েননি বলেই এই ভুল বোঝাবোঝির সৃষ্টি হয়েছে।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, তিন জেলা প্রশাসন এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংকের সাথে ঋণ গ্রহীতার চুক্তিনামা রেজিস্ট্রেশন করার এখতিয়ার পার্বত্য জেলাসমূহে- জেলা প্রশাসকগণের উপর ন্যাস্ত রয়েছে। এই নিয়ম ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ১২ধারা(২) মোতাবেক। অবশিষ্ট ৬১ জেলায় ব্যাংক ঋণের জন্য সাব রেজিষ্টারের অনাপত্তিই যথেষ্ট। কিন্তু পাহাড়ে জেলা প্রশাসকের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে চুক্তি হয় এবং সেই চুক্তি তাঁরই একজন ম্যাজিস্ট্রেট রেজিস্টারভুক্ত করেন।
২০১৭ সালে রাঙামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রথমে এই প্রক্রিয়ার উপর প্রশ্ন উত্থাপন করে ঋণ চুক্তি অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে যদিও নানা দেন দরবারের পর তা খুলে দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে খোলাখোলিভাবে প্রতিবেদকের কাছে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন।
এ বিষয়ে রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জানান, ‘২০১৭ সালে জেলা প্রশাসক প্রথমবারের মতো বাজার ফান্ড এলাকায় ভূমি রেজিষ্ট্রির মিউটেশন ও মিছ মামলাগুলো নিষ্পত্তি স্থগিত করে দেন। আমরা (ব্যবসায়ীরা) তার সাথে দেখা করে বিষয়টি নিয়ে বুঝালেও তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় পরে আমরা এমপি দীপংকর তালুকদারের সহায়তা নেই। এক পর্যায়ে বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করার প্রস্তুতি নেই আমরা। তখন তৎকালীন ডিসি রাঙামাটি চেম্বারের ৫ জন পরিচালককে তার সহকারির মাধ্যমে নিজ কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে আমাদেরকে ভিক্ষুক ফান্ডে অনুদানের শর্তে মিউট ও মিছ মামলা নিষ্পত্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার আশ্বাস প্রদান করেন। আমরা ভিক্ষুক ফান্ডে অনুদান প্রদান করি এবং প্রক্রিয়াটি চালু হয়; দুর্ভাগ্যবশতঃ তার কিছুদিন পর তিনি বদলি হয়ে চলে যান। পরবর্তিতে ডিসি সময়ে ২০১৯ সালের দিকে তিনি বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের বরাত দিয়ে রাঙামাটির বাজার ফান্ড এলাকার জমির ঋণ অনুমোদন কার্যক্রম বন্ধ করে দেন’। এতে করে ঋণ প্রক্রিয়া আটকে থাকায় রাঙামাটির অন্তত ২ হাজার ছোট বড় ব্যবসায়ি/ বিনিয়োগকারি ধ্বংসের পথে।
২০১৯ সালের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ডিসি সূত্র ধরেই খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক ঋণ প্রস্তাবনা অনুমোদন ও রেজিস্টেশন প্রক্রিযা বন্ধ করে দেন। জেলাপ্রশাসনের তহবিলে টাকা জমা দেওয়ার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে অ-বনিবনার এক পর্যায়ে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ^াস ২০১৯ সালের “অক্টোবরে বাজার ফান্ড এলাকায় বন্দোবস্তি দেওয়া জমিকে খাস জমি উল্লেখ করে ওইসব জমির বিপরীতে ঋণ প্রদানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন” এবং এ বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসকের পত্রের প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ০৬/১১/২০১৯ইং তারিখে একটি পত্রের মাধ্যমে উপ-সচিব আসমা তাসকিন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মতামত চায়।
উক্ত পত্রের আলোকে রাঙামাটি জেলা পরিষদের সেই সময়ের চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা দ্রুততার সাথে বিষয়টিকে জনগুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তাঁর ইতিবাচক মতামত পাঠান (১৮/১২/২০১৯ ইং তারিখের পত্রে জানানো হয়, বাজার ফান্ড এলাকার খাস জায়গা বাজার ফান্ড ম্যানুয়েল অনুযায়ী ১০বছরের জন্য লীজ প্রদানের বিধান থাকলেও ১৯৭২ সনে বোর্ড অব রেভিনিউ এর আদেশ মূলে চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস-১৯০০ সনের শাসন বিধির ৩৪নং ধারা বাজার ফান্ড প্রশাসনের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার পর হতে এই জেলার বাজার ফান্ডভূক্ত জায়গা উক্ত ধারা মোতাবেক স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত প্রদান করা হচ্ছে। সেই মতেই বন্দোবস্তকৃত জায়গা কবুলিয়ত রেজিষ্ট্রি সম্পাদন করা হয়। বাজারফান্ড বিধির ৩৪(৫) উপবিধি মোতাবেক এবং কবুলিয়তের ১১নং ধারা/ শর্ত মোতাবেক বাজার ফান্ডভুক্ত জমি বন্ধকী অনুমতি দেওয়ার বিধান রয়েছে। লীজ ফরমে ০৮নং ধারা/শর্ত মোতাবেক বন্ধক রাখার অনুমতি প্রদান করা হয়ে থাকে বলে পত্রে জানানো হয়।
এদিকে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তথা বাজার ফান্ড প্রশাসক (তৎকালীন) ৮/০১/২০২০ খ্রিঃ তারিখে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া পত্রের জবাব দেন। মতামতে জেলাপ্রশাসক- ‘আইনের অধীনে বন্দোবস্তি দেওয়া ভূমিকে খাস জমি’ হিসেবে অভিহিত করার বিষয়টি তিনি দুঃখজনক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি জানান, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ আইন-১৯৮৯(১৯৯৮)সনের সংশোধিত আইন এর প্রথম তফসিলের ১০(গ)অনুসারে বাজার ফান্ড জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর হয়েছে। বিধি অনুযায়ী সম্পাদিত লীজ ফরমে ১১টি শর্তের মধ্যে ৮নং ক্রমিকে বর্ণিত শর্তে বন্দোবস্ত প্রদত্ত প্লট বন্ধক প্রদানের সুযোগ রয়েছে। বাজার ফান্ডের মালিকানা অক্ষুন্ন রেখে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বন্ধকি অনুমতি প্রদান করা হয়। খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ এবং বাজার ফান্ড বিধিমালা ১৯৩৭ অনুসরণে অনুমোদিত হাট-বাজার বন্দোবস্ত প্রদত্ত প্লটের বিপরীতে বাজার ফান্ড কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে ঋণ প্রদানে কোনো বাধা নেই। এমন বাধ্যকতা আরোপ করা হলে এলাকার জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবে বলেও মন্তব্য করেছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তথা বাজার ফান্ড প্রশাসক।