আল মামুন, খাগড়াছড়ি:: জুমধানের বাম্পার ফলনে সবুজ পাহাড়ে চাষীদের মনে লেগেছে আনন্দের জোয়ার। তাইতো জুমের ফসল তোলায় ব্যস্ত এখন পাহাড়ী জুমিয়ারা। কিছু ফসল সারা বছর উত্তোলন হলেও জুম ধান তোলার এখনই মৌসুম।
বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার জুমধান ফলন হয়েছে বেশ। পাকা সোনালী জুম ধানের এখন হাঁসছে সবুজ পাহাড়। ফলন ভালো হওয়ার লাভের আশা করছে চাষীরা। তবে সময়ের পালা বদলে কমছে মাটির উর্বরতাও। ফলে এখন জুমে ব্যবহার বাড়ছে সারের। তাই দিনে দিনে পাহাড়ের জুম চাষ কমে যাচ্ছে।
সবুজে ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যবাহী ‘জুমচাষ’ চাষবাষ পদ্ধতি এখনো প্রচলিত থাকলেও সময়ের সাথে তা বদলাতে শুরু করেছে। যদিও পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জুমিয়ারা ঐতিহ্যগতভাবে জুমচাষে নির্ভর করে জীবনধারন করে। জীবনের তাগিদে জুমচাষীরা পাহাড়ে ধান, ভূট্টা, কাকন, মারফাসহ বিচিত্র রকমের ফসল করেছেন। বর্তমান সময়ে জুমে ধান পাকায় তা কাটা চলছে। বৃষ্টি ও আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ভালো ফলনে পাহাড়ি পল্লিগুলোতে এখন ধান কাটা ও ঘরে তোলায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে চাষীরা।
আলুটিলা এলাকার জুমচাষী হীরা দেবী বলেন, আমরা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। সারা বছর কষ্টের পর এখন ঘরে ফলন তোলার সময়। গত বছরের তুলনায় এবছর ফলন ভালো হয়েছে। তবে আগে মাটির উর্বরতার কারণে সার ব্যবহার করতে না হলেও এখন জুমে সার দিতে হয়।
আধুনিক পদ্ধতিতে জুম চাষের কারণে এমন ফলন পাচ্ছে কৃষক। কারণ দিনে দিনে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় ও উর্বরতা কমে যাওয়ার কারণে জুম পাহাড়ে বাড়ছে সারের ব্যবহার। আগে এক পাহাড়ে দীর্ঘ বছর পরপর জুম চাষ হলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জুম পাহাড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন একই পাহাড়ে প্রতি বছর জুম চাষ করা হচ্ছে।
তবে জুম চাষের আধুনিক পদ্ধতি পাল্টে দিয়েছে চাষাবাদের ধরন। এই পদ্ধতিতে পরিমিত সার ব্যবহার করে প্রতি বছর একি জমিতে বার বার ফসল উৎপাদন করতে সম্ভব বলে তিনি জানান।
জুম চাষী নব জ্যোতি ত্রিপুরা বলেন ‘এমন একটা সময় ছিল যখন এক পাহাড়ে জুম চাষ করার পর অন্য পাহাড়ে জুম চাষ করা হতো। কিন্তু এখন মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে বসতি। তাই জুমের জায়গা কমে আসছে। এখন একই স্থানে প্রতি বছর জুম চাষ করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে স্থায়িত্বশীল এবং অধিক উৎপাদনশীল জুমচাষের উপায় বের করার গবেষনা করছে বাংলাদেশ কৃষি ফাউন্ডেশন। এই গবেষনায় মূলত: সার-কিটনাশকের পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমে একই জমিতে প্রতিবছর জুমচাষের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখা হয়। গত চার বছর ধরে চলা গবেষনায় বৈজ্ঞানিক ও কৃষিবিদরা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সফলতার মুখ দেখেছেন। উদ্বুদ্ধ জুম কৃষকরাও।
এ বছর জেলায় ১হাজার ৯শ ১০ হেক্টর জমিতে জুম চাষ হয়েছে। যেখান থেকে ২হাজার ৯শ ৮৬ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মর্তুজ আলী জানান, মূলত স্থানীয় জাত থেকে জুমের উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশ পারমানবিক ইনিস্টিটিউট বিনা ধান-১৯ এবং বিনা ধান-২১ উদ্ভানব করেছে। যেটি কিনা স্থানীয় জাতের তুলনায় ভালো ফলন দিচ্ছে। এছাড়াও বিরি ধান-৮৩ এবং চায়না। এখানেও স্থানীয় জাতের তুলনায় ভালো ফলন হচ্ছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি গবেষনা ইনিস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সী রশিদ আহম্মেদ বলেন, স্থানীয় জাতের তুলনায় আধুনিক জাতগুলো প্রায় দেড়গুণ বেশি উৎপাদন হচ্ছে। নতুন জাতগুলোর বীজ যদি জুম চাষীদের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমানে ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে স্থানীয় জাতের বাইরে উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহার করে অধিক লাভের মুখ দেখবে। তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে।
আগামীতে গবেষনা জ্ঞান মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পারলে পাহাড়ের জুম চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে এবং জুমিয়াদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীরা।