ডা. কাওসার আলম
গতকাল একজন চিকিৎসক ফোন দিয়ে খুব কান্না বিজড়িত কন্ঠে বললেন, ভাই আমি কোভিড পজিটিভ। আমার বাবাও কোভিড পজিটিভ।আমার বাবা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ওয়ার্ডে ভর্তি। ১৫ লিটার করে প্রতি মিনিটে অক্সিজেন পাচ্ছে তাতেও উনার শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি আমার বাবার পাশে আছি। আমার নিজের শারীরিক অবস্থাও ভালো না ভাই, প্লিজ দোহাই লাগে যেখানে পারেন একটা আইসিইউ ব্যবস্থা করে দেন।
এই ফোনটি আসার দশ মিনিট আগেই আমি সকল সরকারি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ফোন দিয়ে জানলাম কোন আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই। আমার সাহস হল না, তার মুখে মুখে বলা যে ভাই কোন আইসিইউ বেড ফাঁকা নাই।।একজন অসহায় মানুষকে আমি আশাহত করতে চাইনি।।বাবার জন্য শেষ চেষ্টাটুকু সবাই করতে চায়। বললাম আমি সরকারি- বেসরকারী সব আইসিইউতে খবর নিচ্ছি। দেখি কিছু করা যায় কিনা।
সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা আছে কিনা সেটা খবর নেওয়ার কারণ ছিল এক ডাক্তারের।মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ট্রায়াজ সেন্টারে নেওয়ার পর ওরা পরীক্ষা করে বলল, উনার আইসিইউ লাগবে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই। তারা রোগীকে নিয়ে আনোয়ার খান মডার্ণ, হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই। উনার কথাগুলো ঠিকমত বুঝতেও পারছিলাম না উনার হাউমাউ করে কান্নার শব্দে।
এই চিত্রগুলো দেখলেই বুঝতে পারি আমরা কতটা অসহায়? আমরা চিকিৎসক ও চিকিৎসকের পরিবারের সবাই সত্যিই খুব অসহায় অবস্থায় আছি। চিকিৎসক হয়ে আমরা পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত করছি কিন্তু তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছি না। আমরা আমাদের পরিবারের কাছে কতটা অকৃতজ্ঞ।
কোভিড পরিস্থিতিতে ইউরোপ আমেরিকায় মা বাবা আক্রান্ত হলে সন্তানেরা খোঁজ নিতে যায় না। সন্তান আক্রান্ত হলে মা বাবা খোঁজ নেয় না। মারা গেলে হয়ত একটা ফোন আসে কিন্তু লাশটি শেষকৃত্য করতেও কেউ যায়না। কিন্তু আমরা পরিবার থেকে সেই শিক্ষা পাইনি। আমাদের দেশে বাবা মা আক্রান্ত হলে সন্তানরা বসে থাকে না। সে কোভিড পজিটিভ বা নেগেটিভ যাই হোক না কেন। সে তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে তার মা বাবাকে একটু অক্সিজেন দিতে। চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে, আইসিইউ বেড দিতে। আমরা অনেক আবেগী জাতি। অন্যের কান্না দেখে আমরা কান্না করি। অন্যের দুঃখ দেখে আমরা কষ্ট পাই। অজানা অচেনা কোভিড আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির জানাজা পড়তে আমরা জড়ো হই আমরা সেই জাতি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা চিকিৎসকরা জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে নিজেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের প্রতিটি অসুস্থ মানুষের পাশে আছি। আমরা আক্রান্ত হচ্ছি, আমাদের পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের হাজারের অধিক চিকিৎসক আক্রান্ত, হাজার হাজার চিকিৎসক পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত। অনেকেই হাই ফ্লো অক্সিজেন পাচ্ছে না। অনেকেই আইসিইউ পাচ্ছে না।
জাতির এই চরম দুঃসময়ে যারা জনগণের পাশে থাকবে তারাই তো জনগণের প্রকৃত ভাই বা প্রকৃত বন্ধু। করজোড়ে অনুরোধ জনগণের প্রকৃত বন্ধুদের জন্য শেখ রাসেল ভাইয়ের নামে করা হাসপাতালটি আপনি চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দ দিন। এতে শেখ রাসেল ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে।
এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকরা সুস্থ হয়ে হাজার হাজার মানুষকে আবার চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করবে। সেসব সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা মানুষ ও তার পরিবারের সদস্যদের দোয়া শেখ রাসেল ভাইয়ের আত্মায় পৌঁছে যাবে ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশে একটি পরিবার শুধু এদেশের মানুষের ভাল করার জন্য সারাজীবন ত্যাগ, ও জীবন দিয়ে গেছে। সেই দেশপ্রেমিক পরিবারের কাছে জনগনের চিকিৎসা সেবক হিসেবে আমাদের একটি চাওয়া, আপনি আমাদের ফিরিয়ে দিবেন না। আপনি একটা নীরব জরিপ করে দেখতে পারেন দেশের মানুষও সমর্থন দিবে যে, এইসময়ে ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ করা চিকিৎসকদের জন্য একটি পৃথক হাসপাতাল প্রয়োজন। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল চিকিৎসকদের জন্য দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য পক্ষ-বিপক্ষে জনমত নিয়েও দেখতে পারেন। আমার মনে হয় সচেতন জনগণ সবাই সমর্থন করবে।
আঁধার কেটে যাবে , সুদিন ফিরে আসবেই। কিন্তু সুদিন ফিরে আসার আগেই যদি আমরা আমাদের প্রখ্যাত চিকিৎসক ও গুণীজনদের হারাই তাহলে।আবার ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের অনেক সময় লাগবে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করায় ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের প্রায় ৪৫ বছর লেগেছে। আবার এই কোভিড যুদ্ধে যদি আমরা আমাদের দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের হারাই তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে কতদিন লাগবে তা অনুমান করাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
করোনাকালেও একটাই প্রত্যাশা পৃথিবীর নির্মল বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিক আমার মাতৃভূমি। ভাল থাকুক আমার প্রিয় স্বদেশ।
লেখক: মেডিকেল অফিসার ও ফেইজ-বি রেসিডেন্ট, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদালয়